বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা টনক নড়ছে না কারোরই
৭০ শতাংশ ইঞ্জিন ও কোচ মেয়াদোত্তীর্ণ
বড় বিনিয়োগের পরও বছরে লোকসান দুই হাজার কোটি
রেলের উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও নিরাপদ হয়নি দেশের রেলপথ। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথের দুই-তৃতীয়াংশই ঝুঁকিপূর্ণ। মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও চলছে ৭০ শতাংশ রেল ইঞ্জিন ও কোচ। আর তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা। এছাড়া, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরও প্রতি বছর রেলের গড় লোকসান প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের খেসারত দিচ্ছে জনপ্রিয় এই পরিবহন খাতটি। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, দেশে রেললাইনে দুই হাজার ৭৮৯টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ৫৬৪টিতে গেটম্যান রয়েছে। ক্রসিংগুলোর মধ্যে এক হাজার ৩২১টির কোনো অনুমতিই দেয়নি বাংলাদেশ রেলওয়ে। অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের মধ্যেও ৯০৪টিতে গেটম্যান নেই। যে যার খেয়ালখুশি মতো রেললাইন অতিক্রম (ক্রসিং) করে রাস্তা বানিয়েছে, তার বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ।
রেলওয়ে বলছে, খোদ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রেলওয়েকে না জানিয়ে লেভেল ক্রসিং তৈরি করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান থাকে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে লেভেল ক্রসিং তৈরি করেছেন। আবার খোদ রেলওয়ে থেকে যেসব ক্রসিংয়ের অনুমোদন আছে, সেসব ক্রসিংয়েরও অধিকাংশ স্থানে গেটম্যান নেই। ফলে ট্রেন এলেও সিগন্যাল দেয়ার কেউ থাকে না। এতে সারা দেশে রেলক্রসিংয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে তাজা প্রাণ। তবে এর সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউই। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ এবং ক্রসিং ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন না হলে এসব দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলে তাদের অনুমোদিত ৪৩৪টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটম্যান আছে ২৪৫টিতে, নেই ১৮৯টিতে। পশ্চিমাঞ্চলে এক হাজার ৩৪টি ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটম্যান আছে ৩১৯টিতে, নেই ৭১৫টিতে। সব মিলিয়ে অনুমোদিত এক হাজার ৪৬৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে ৯০৪টিতেই গেটম্যান নেই। সারা দেশে অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে এক হাজার ৩২১টি।
এর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ৪৫৮টি, এলজিইডির অর্থায়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্মিত ৫০২টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ১২টি, সিটি কর্পোরেশনের ৫৪টি, উপজেলা পরিষদের ৯টি, পৌরসভার ১১৬টি এবং অন্যান্য ১৭০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে।
এদিকে, রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় ৯৯৮টি মামলা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এক হাজার ১৭ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৭৯৪ এবং নারী ২২৩ জন। ট্রেন লাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৫০৪ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয়েছে ২৭২ জনের। কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৭৬ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের এবং অপমৃত্যু হয়েছে (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৪২ জনের। এর আগে ২০২৩ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মোট মামলা হয় এক হাজার ৫৪টি। মোট মরদেহ উদ্ধার করা হয় এক হাজার ৬৪ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৮২৬ এবং নারী ২৩৮ জন। ট্রেনলাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয় ৫০২ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয় ৩৮৭ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২৩ জন ও কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ১৮ জনের। অপমৃত্যু হয় (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৩৪ জনের।
রেলের আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান লেভেল ক্রসিং তৈরি করতে চাইলে রেলওয়ের অনুমতি নিতে হবে। লেভেল ক্রসিংয়ের প্রয়োজন উপলব্ধি করে রেল অনুমতি দিলে ক্রসিং তৈরি থেকে শুরু করে গেটম্যানের বেতনসহ সম্পূর্ণ খরচ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে। তবে ব্যয় নির্বাহ তো দূরের কথা, ক্রসিং তৈরির আগে অনুমতিই নেয় না অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
রেলের তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন ৬৩ শতাংশ। নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঠের স্লিপার আর জং ধরা ফিশপ্লেটেই ঘুরছে ট্রেনের চাকা। ৭০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন আর কোচ দিয়েই চলছে যাত্রী পরিবহন। লোকবল সংকটের কারণে ভাড়া করা অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে করানো হচ্ছে অপারেশনাল কাজ। ফলাফল প্রতি বছর বাড়ছে দুর্ঘটনা। তাই নিরাপদ এই বাহনের যাত্রীদের চোখেমুখে এখন ভয় আর শঙ্কা।
যাত্রীরা বলছেন, বাসগুলো চলাচলের সময় প্রতিযোগিতা করে। তাই ট্রেনকেই তারা নিরাপদ মনে করেন। কিন্তু এখন ট্রেনও দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। অব্যবস্থপনার কারণেই দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে আরও গুরুত্ব দেয়া উচিত।
এদিকে, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হলেও বাড়েনি ট্রেনের গতি বরং কমেছে অনেক রুটেই। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় কোথাও কোথাও ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে চালকদের। ১০ বছরেও কমেনি যাত্রীদের অভিযোগ। এখনও টিকিট সংকট আর শিডিউল বিপর্যয় নিত্যসঙ্গী রেলপথের যাত্রীদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যা দরকার তা না করে গত দেড় দশকে বিলাসী প্রকল্পে ঝুঁকছে রেল। ফলে অপরিকল্পিত অর্থ খরচের খেসারত দিচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদনকৃত লেভেল ক্রসিংয়েরও অধিকাংশ স্থানে গেটম্যান নেই, এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেমন- পৌরসভা, এলজিইডি, সিটি কর্পোরেশন এ ধরনের কিছু সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা নিজেদের সুবিধার জন্য যেখানে সেখানে রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করছে। এসব রাস্তা নির্মাণে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। রেলওয়ে আইনের নিয়মনীতি না মেনে তারা রাতারাতি রাস্তা তৈরি করে ফেলছে।
তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের প্রকল্প নেয়া উচিত। এছাড়া এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও জনবল সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য এটা বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে।