একসময় ঈদের কেনাকাটা মানেই ছিল ভারতীয় কাপড়ের আধিপত্য। তবে জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ছেদ পড়েছে ভারতীয় পণ্যে। একক আধিপত্য ভেঙে দাপট বেড়েছে দেশীয় কাপড়ের। কেউ বলছেন ভারতীয় পণ্য বয়কট, কেউ বলছেন দেশীয় পণ্যের মান ভালো হওয়ায় ভারতীয় পণ্য কিনছেন না তারা।
তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবার এলসি (ঋণপত্র) করে কাপড় আনার কারণে দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় অধিকাংশ ক্রেতা দেশীয় কাপড় কিনছেন। এদিকে দেশি কাপড় বিক্রির পাশাপাশি পাকিস্তানি কাপড়ও বিক্রি হচ্ছে বেশ। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এক সময় ভারতীয় সিরিয়াল নাটকের নামে পোশাক কিনতে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। ঈদে ভারতীয় পোশাক কিনে না দেয়ায় আত্মহত্যা এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত হয়েছে। তবে বহু বছর পর এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ভিসা জটিলতার কারণে ভারতীয় পণ্য আসতে না পারার কারণে রাজধানীর অনেক মার্কেটে ভারতীয় পণ্য নেই বললেই চলে।
ক্রেতারা বলছেন, এখন পাকিস্তান, চীন, দুবাই, তুরস্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পণ্য পছন্দ তাদের। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, মার্কেটগুলোতে লোকজনেরও কেনাকাটা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। শুধু ইফতারের সময় ছাড়া প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। তবে বেচা বিক্রিতে অনেকে সন্তোষ প্রকাশ করছেন। তবে অনেকেই বলছেন গতবারের তুলনায় এবার দাম কিছুটা কম।
বিক্রেতারা জানান, ক্রেতারা সব সময় ভালো পোশাক পছন্দ করে থাকেন। সেটা হতে পারে দেশি আবার হতে পারে বিদেশি। ভিসা জটিলতার কারণে কোনো দেশ থেকে কাপড় আসতে না পারলেও তাতে কোনো সমস্যা নেই। সেই স্থানটা দেশি কাপড় দিয়েই পূর্ণ হচ্ছে।
রাহিমা বেগম নামে এক ক্রেতা বলেন, আমি ইন্ডিয়ান, পাকিস্তান দেশি-বিদেশি কখনো গুরুত্ব দিই না। আমার কাছে যেই মডেল বেশি ভালো লাগে সেটাই পছন্দ। খালিদ হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, আগে ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবি কিনলেও এবার দেশিটা কিনেছি। মার্কেটে ইন্ডিয়ান কালেকশন মোটামুটি আছে, তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের দেশি ভালো ফেব্রিক্স পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া আমাদের দেশি কাপড় বিভিন্ন দেশে আমদানি হচ্ছে। মান ভালো বলেই আমাদের দেশি কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। এখন থেকে আমার প্রথম পছন্দ থাকবে দেশি কাপড়।
রাকিব মজুমদার নামের আরেক ক্রেতা বলেন, যার ইন্ডিয়ান কাপড় পছন্দ সে ইন্ডিয়ান কাপড় কিনবে। আর যার ইন্ডিয়ান কাপড় পছন্দ নয়, তারা দেশি কাপড় কিনবে। এখন দেশি অনেক ভালো ভালো কাপড় পাওয়া যাচ্ছে। দেশে ভালো কাপড় তৈরি হয় বলেই বিদেশিরা ক্রয় করে নিচ্ছেন।
নয়াপল্টন এলাকার পলওয়েলের ব্যবসায়ী রাজু আহমেদ বলেন, ইন্ডিয়ান পণ্য কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তবে এটা কোনো সমস্যা নয়। পাকিস্তান চায়নার পর্যাপ্ত পণ্য রয়েছে। এছাড়া দেশি অনেক ভালো ভালো পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান কাপড় না আসার কারণে সেই স্থানটা দেশি কাপড়েই দখল করবে বলে জানান তিনি। মৌচাকের ফরচুন শপিং মলের মদিনা শাড়ি ও থ্রি পিস শোরুমের আব্দুল হাকিম বলেন, ভিসা জটিলতার কারণে এ বছর ইন্ডিয়ান কাপড় সরাসরি আনা সম্ভব হচ্ছে না। ঈদের পূর্বে থার্ড পার্টির মাধ্যমে কিছু কাপড় আনতে সক্ষম হয়েছি। তবে টাকার মান কমে যাওয়ায় গতবারের তুলনায় ইন্ডিয়ান কাপড়ের দাম অনেক বেশি পড়ছে। দাম বেশি হওয়ায় কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। সব মিলে এবার ব্যবসার অবস্থা বেশি ভালো নয়। গতবারে এই সময় অনেক ভালো ছিল।
মৌচাকের চৈতী স্টাইলের পরিমল দেবনাথ বলেন, চলতি বছর ইন্ডিয়ান কাপড় অনেকটাই কম আসছে। পাশাপাশি বিক্রিতেও ভাটা পড়েছে। প্রতিবছরের তুলনায় এ বছর ইন্ডিয়ান কাপড় বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। ইন্ডিয়ান কাপড়ের চাহিদা মেটাচ্ছে দেশি এবং পাকিস্তানি কাপড়ে। সর্বোপরি দেশি কাপড়ে চাহিদা বেড়েছে। স্থানীয় পণ্যের বাজারেও এসেছে বৈচিত্র। যেমন বিভিন্ন ধরনের ডিসকাউন্টের মাধ্যমে দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের প্রচরণা চালাচ্ছে। এছাড়া দেশীয় শপিং মলগুলো তাদের স্টক বাড়িয়ে ফেলা এবং নতুন পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগী হয়েছে, যা ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন পণ্যের দামও নাগালের মধ্যে রাখা হয়েছে, যা গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে।
এবার ঈদে ভারতে যাওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা করার প্রবণতা আরও শক্তিশালী হয়েছে। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাজারে একটি স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। ব্যবসায়ীরা এখন এ পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে নিজেদের বাজার বিস্তৃত করার নতুন কৌশল হাতে নিতে শুরু করেছেন। নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর পাশাপাশি এখন তারা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তনটি শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে গিয়ে দেশীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের উৎপাদনশীলতা ও শিল্পের বিকাশে সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি, স্থানীয় ব্যবসা ও সেবাদাতাদের সুযোগও বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করবে।
এদিকে ভারতের ভিসা জটিলতার কারণে এর প্রভাব পড়েছে চিকিৎসা খাতেও। প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়। ভিসা জটিলতার ফলে চিকিৎসার জন্য অনেক বাংলাদেশিই ঝুঁকছেন থাইল্যান্ড-চীনের দিকে। ইতোমধ্যে চিকিৎসা সেবা নিতে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইউনানে গিয়েছেন বেশ কিছু বাংলাদেশি।
অন্যদিকে দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে ভারত শীর্ষ থেকে সাত নাম্বারে নেমেছে। অর্থাৎ আগে যেখানে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সব থেকে বেশি ভারতে খরচ করতেন সেখানে তা কমতে কমতে সাত নম্বরে চলে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ভারতকে ছাপিয়ে এখন বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্য।
ভারত বিমুখতা দেশের বাজারের জন্য কতটা সুফল আনবে তা জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যারা ভারতে কেনাকাটার জন্য যেতেন তাদের একটা অংশ অন্য জায়গায় যাচ্ছে। তবে বড় একটা অংশ দেশেই কেনাকাটা করবেন। সে হিসেবে আমাদের দেশীয় পণ্য একটু বেশি বিক্রি হবে। ভারতের ভিসা কড়াকড়ির কারণে আমাদের আরও বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। গ্লোবালাইজেশন বাড়ছে। যেমন আগে ভারতে গিয়ে খরচ করত, এখন মানুষ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন ও ব্যাংকক যাচ্ছে।