বিপর্যয়ের মুখে ট্রাভেল এজেন্সি খাত

সুমন খান প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৫, ১২:০০ এএম
বিপর্যয়ের মুখে ট্রাভেল এজেন্সি খাত

গত কয়েক মাস ধরেই পর্যটন খাতের ব্যবসায়ী মহলে বিরাজ করছে অস্থিরতা। এ খাতের দুুটি সক্রিয় সিন্ডিকেটের পরস্পরবিরোধী অভিযোগ আর স্বৈরাচারের দোসরদের অপতৎপরতা রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপে বন্ধের উপক্রম হয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি ট্রাভেল এজেন্সি। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ।

সিন্ডিকেটকে দায়ী করেই তারা বলছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পুরো খাতটিই বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ ও সাধারণ সম্পাদক আফসিয়া জান্নাত সালেহের নেতৃত্বাধীন বিতর্কিত কমিটি বাতিল করে দ্রুত প্রশাসক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায় বর্তমানে দুটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। একটিতে আবদুস সালাম আরেফ ও আসফিয়া জান্নাত সালেহ, যারা পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে পরিচিত। অপরটি আটাব সংস্কার পরিষদের আহ্বায়ক ও মঈন ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী গোফরান চৌধুরী মলয়, যিনি বিএনপি-জামায়াতপন্থি হিসেবে পরিচিত।

সম্প্রতি আরেফ-সালেহ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে স্বৈরাচারের দোসর হয়েও বহাল তবিয়তে থাকাসহ বিএনপি-জামায়াতপন্থি ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চেষ্টার অভিযোগ করেন আটাব সংস্কার পরিষদের আহ্বায়ক ও মঈন ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী গোফরান চৌধুরী মলয়।

অভিযোগে বলা হয়, আরেফ-সালেহ আটাব অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) নামক একটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাণিজ্যসংঘ বিধি ও আটাব সদস্যদের স্বার্থের পরিপন্থী। ওটিএ ব্যবহার করে আরেফের মালিকানাধীন ট্রাভেল এজেন্সি এয়ার স্পিড (প্রা.) লিমিটেডও সালেহের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সায়মন ওভারসিজের নামে চেক ইস্যু করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের পর আটাব অনলাইনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তারা। শেয়ারহোল্ডারদের টাকাও ফেরত দেননি।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, আরেফ আ.লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা বাহাউদ্দিন নাসিমের আত্মীয় পরিচয়ে এবং প্রশাসনের সহায়তায় ২০১১ সাল থেকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন দিয়ে দুইবার মহাসচিব এবং বর্তমান সভাপতি হিসেবে আটাব দখল করে আছেন। ভৌতিক ভোটার তালিকা, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট এবং প্রতিপক্ষকে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে স্বঘোষিত ফলাফল নিয়ে বারবার নির্বাচিত হয়ে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারও জিয়ারত করেন। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট আন্দোলন প্রতিহত করতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ে ৩ আগস্টেও সভায়ও উপস্থিত ছিলেন তিনি। এছাড়া মহাসচিব সালেহ আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মরহুম মুহায়মিন সালেহর কন্যা। সালেহও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আ.লীগ নেত্রী পরিচয়ে আটাবের নেতৃত্বে আসেন এবং নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে কমিটির সবাইকে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারত করেন।

প্রস্তাবিত ট্রাভেল এজেন্সি পরিপত্র : এদিকে দুটি সিন্ডিকেটের কাদা ছোঁড়াছুড়ির মধ্যেই ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা পরিচালনার জন্য একটি খসড়া পরিপত্র তৈরি করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কার্যত এই পরিপত্রের বাস্তবায়ন হলেই বন্ধ হয়ে যাবে পাঁচ হাজারেরও অধিক এজেন্সি। সূত্র বলছে, কতিপয় অসাধু ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের সঙ্গে যোগসাজশেই পরিপত্রটি তৈরি করা হয়েছে। মনোপলি ব্যবসার জন্যই পরিপত্রটি জারির কৌশল নিয়েছে চক্রটি। যার নেপথ্যে রয়েছে আরেফ সিন্ডিকেট— এমনটা বলছেন শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।  

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে পাঁচ হাজার ৭৪৬টি লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৯৭০টি ট্রাভেল এজেন্সি আয়াটার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ৯৭০টির মধ্যে কেবল ৩৫০টি ট্রাভেল এজেন্সির কাছে এমিরেটস এয়ারলাইনস, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসসহ বড় বড় এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রির অনুমতি (ক্যাপিং) রয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রির অথরিটি পেতে হলেও আয়াটাসহ সবমিলিয়ে ৪০ লাখ টাকা অগ্রিম জমা দিতে হয়।

এছাড়া এয়ার অ্যারাবিয়া, ইন্ডিগো, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজের মতো বাজেট এয়ারলাইনস রয়েছে, যাদের টিকিট আয়াটাতে পাওয়া যায় না। দেশের পাঁচ হাজারের বেশি লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট সংগ্রহের জন্য ৩৫০টি ট্রাভেল এজেন্সির ওপর নির্ভরশীল।

এ অবস্থায় এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে টিকিট কেনাবেচা করতে না পারলে পাঁচ হাজারের বেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাঝারি ও ছোট পরিধির প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। পরিপত্রের খসড়ার (ণ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে টিকিট ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না।’

খসড়া পরিপত্রের এই ধারার বিরোধিতা করে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, বিশ্বব্যাপী ট্রাভেল ব্যবসায় এজেন্ট টু এজেন্ট (বি-টু-বি) মডেল প্রচলিত রয়েছে। যেখানে এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করতে পারে। বাংলাদেশে এই নিয়মের ব্যত্যয় হলে স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। পাশাপাশি এই সেক্টরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খসড়া পরিপত্রের (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা করার জন্য আবশ্যিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন আয়াটার স্বীকৃতি ও সদস্যপদ নিতে হবে।

যদিও এজেন্সির মালিকরা বলছেন, আয়াটা মূলত টিকিট সেলিং প্ল্যাটফর্ম। বিশ্বে দুই ধরনের ট্রাভেল এজেন্সি থাকে। আয়াটা এবং নন-আয়াটা ট্রাভেল এজেন্সি। তবে পৃথিবীর কোথাও ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসার জন্য আয়াটার মাধ্যমে টিকিট বিক্রি বাধ্যতামূলক নয়।

জানা গেছে, সাধারণত বড় বড় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আয়াটার সদস্যপদ লাভ করে। কারণ আয়াটায় সব এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রির অথরিটি পেতে হলে কোটি কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির পাশাপাশি কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া আয়াটায় কম টাকার ব্যাংক গ্যারান্টিতে সব এয়ারলাইনসের টিকিট কাটার অনুমতি পায় না। একটি এজেন্সিকে আয়াটার সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে হলে কমপক্ষে ৬ মাস ব্যবসা করতে হয়। পাশাপাশি সর্বনিম্ন ৩০ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টিসহ আরও নানা কাগজপত্র আয়াটার বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার বরাবর জমা দিতে হয়। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ৩০ লাখ টাকার গ্যারান্টিতে মাত্র ৩-৪টি এয়ারলাইনসের টিকিট কাটার অনুমতি মেলে। ট্রাভেল এজেন্সি গ্যারান্টিকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ২১ লাখ টাকার টিকিট কিনতে পারে।  

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত এজেন্সিগুলোর মধ্যে চার হাজার ৪৭৬টি ৮৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেরই আয়াটার স্বীকৃতিপত্র নেই। ফলে নতুন পরিপত্র জারির সঙ্গে সঙ্গে এই এজেন্সিগুলো আর টিকিট বিক্রি করতে পারবে না। ফলে টিকিটের সংকট দেখা দেবে, ভোগান্তিতে পড়বে যাত্রীরা।

তবে জানতে চাইলে আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের সঙ্গে সরকারের যে আলোচনা হয়েছে, সেখানে এ বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। আমরা বিষয়টি জানি না। তবে খসড়া পরিপত্রের কথা আমরাও শুনেছি কিন্তু এখনো দেখিনি। তিনি বলেন, যে পরিপত্রের কারণে কোনো ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাবে সেটা আমরা মানব না। এতে ট্রেডে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। টিকিটের দাম কমানো দূরের কথা উলটো হু-হু করে বাড়বে। পরিপত্র তৈরির নেপথ্যে আপনাদের ভূমিকা রয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আমরা করিনি। মন্ত্রণালয়ে আসা অভিযোগটি এসেছে এয়ারলাইন্স থেকে। হাত বদলের মাধ্যমে টিকিটের দাম বাড়ে— এয়ারলাইন্সের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতেই পরিপত্রটি হয়ে থাকতে পারে।

তবে পরিপত্রের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, এতে ট্রাভেলস ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা চাই সব ট্রাভেল এজেন্সি যাতে ব্যবসা করতে পারে সে ধরনের পরিপত্র হোক। আমরা স্বাগত জানাব। অন্যথায় আমরা মানব না। এদিকে তাদের বিরুদ্ধে গোফরান চৌধুরীর করা অভিযোগের বিষয়টি তিনি জানেন বলেও জানিয়েছেন।