কলকাতা-চেন্নাই ও আহমেদাবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ
বিলটি পাস হলে খর্ব করবে মুসলিম অধিকার
বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ-বিবৃতি
অ-বিজেপি সরকার এলে বিল বাতিলের ঘোষণা মমতার
ভারতে মুসলমানদের দান করা শত শত কোটি ডলার মূল্যের ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও বহু বছরের পুরনো পরিচালনা পদ্ধতি সংশোধনে আনা একটি বিল লোকসভায় পাস হয়েছে। টানা ১২ ঘণ্টার বেশি তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর গত বুধবার রাতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি পাস হয়। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, বিলটি আইনে পরিণত হলে তা ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনবে। কিন্তু বিরোধী দল এবং প্রায় সব মুসলিম সংগঠনই বলছে, এই বিলটি আনাই হয়েছে ভারতের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করতে।
গত বুধবার লোকসভায় বিলটি ২৮৮-২৩২ ভোটে পাস হয়। নিম্নকক্ষে পাস হওয়ায় এটি এখন রাজ্যসভায় যাবে। সেখানে পাস হলে যাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে। তিনি স্বাক্ষর করলে সেটি আইনে পরিণত হবে। এদিকে বিতর্কিত ওই বিলটি লোকসভায় পাস হওয়ায় বাংলাদেশেও এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বিবৃতি দিয়ে ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাসের নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
অপরদিকে, লোকসভায় বিতর্কিত মুসলিম ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাসের প্রতিবাদে গত শুক্রবার কলকাতা, চেন্নাই ও আহমেদাবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। জুমার নামাজ শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষোভকারীরা জাতীয় পতাকা ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল প্রত্যাখ্যান’ স্লোগান দেন। পশ্চিমবঙ্গে আগামী বছর নির্বাচনের মুখে এই বিক্ষোভ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতোমধ্যে বলেছেন, তিনি রাজ্যের মুসলিমদের জমি হারাতে দেবেন না। বিজেপিকে দেশ বিভক্ত করার চেষ্টার অভিযোগ এনে তিনি বলেছেন, নতুন অ-বিজেপি সরকার কেন্দ্রে গঠিত হলে এই বিল বাতিল করা হবে।
ওয়াকফ কী : ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, মুসলিমরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণে তাদের সম্পত্তি দান করে। এটিই হচ্ছে ওয়াকফ বা ধর্মীয় দান। এসব সম্পত্তি আল্লাহর, তাই এগুলো বিক্রি বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না, এমন ধারণা প্রচলিত। ওয়াকফ সম্পত্তির একটি বিশাল অংশ মূলত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এবং এতিমখানা নির্মাণে ব্যবহূত হয়। এছাড়া অনেক সম্পত্তি খালি পড়ে থাকে, না হয় বেদখল হয়ে যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার শাসকরা দিল্লির সালতানাতে বসার পর থেকেই ভারতে ওয়াকফ ঐতিহ্য চলে আসছে। এসব ওয়াকফ সম্পত্তি এখন ওয়াকফ অ্যাক্ট, ১৯৯৫ এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইনের অধীনে রাজ্যভিত্তিক বোর্ড গঠন করা হয়। এসব বোর্ডে রাজ্য সরকারের মনোনীত ব্যক্তি, মুসলিম আইন প্রণেতা, রাজ্য বার কাউন্সিলের সদস্য, ইসলামিক পণ্ডিত এবং ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপক অন্তর্ভুক্ত থাকেন। দেশটির সরকার বলছে, ভারতে এখন যারা বিশাল বিশাল জমির মালিক, তাদের মধ্যে ওয়াকফ বোর্ডগুলো অন্যতম। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ভারতজুড়ে কমপক্ষে ৮৭২৩৫১টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। ৯ লাখ ৪০ হাজারের বেশি একরের এসব সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য এক লাখ ২০ হাজার কোটি রুপি।
কেন বিতর্ক : মুসলিমরা আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। বিলের সবচেয়ে বিতর্কিত প্রস্তাবগুলোর একটি হলো ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা বিধিতে পরিবর্তন, যা বোর্ডের অধীনে থাকা অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ, দরগা এবং কবরস্থানগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে। এসব সম্পত্তির অনেকগুলোই কয়েক প্রজন্ম ধরে মুসলমানরা ব্যবহার করছে। কিন্তু এসব সম্পত্তির নথিপত্র নেই। কারণ কয়েক দশক বা শতাব্দী আগে মৌখিকভাবে বা আইনি নথি ছাড়াই এগুলো দান করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ওয়াকফ আইনের মাধ্যমে এসব সম্পত্তি ‘ব্যবহারকারীর ওয়াকফ’ হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সেই বিধানটি বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির বিশাল একটি অংশর ব্যবস্থাপনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিকওয়া-ই-হিন্দ : দ্য পলিটিক্যাল ফিউচার অব ইন্ডিয়ান মুসলিমস-এর লেখক অধ্যাপক মুজিবুর রেহমানের ভাষ্য, এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী সমপ্রদায়ের সম্পত্তির মালিকানা খুঁজে বের করা জটিল, কারণ তাদের ব্যবস্থাপনা এবং কাজের পদ্ধতি কয়েকশ বছর আগের মোগল ব্যবস্থা থেকে শুরু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় এবং বর্তমান পর্যন্ত চলে এসেছে।
‘আপনি কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির সন্ধান করতে পারেন, তবে একটি সমপ্রদায়ের সম্পত্তি শনাক্ত করা আরও কঠিন, কারণ তাদের ব্যবস্থাপনা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়।’ অনেকেই বলছেন, নতুন বিলটি মুসলিমদের উদ্বেগের সমাধান করতে না পারলেও ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে কেড়ে নিতে পারে। কারণ ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে সংশোধনীতে।
কেন ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিরোধিতা : ভারতে মুসলিমদের দান করা সম্পত্তি, অর্থাৎ ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা গঠিত কয়েক; দশকের পুরনো একটি আইন সংশোধন করার উদ্যোগে দেশটির মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ভারতে মসজিদ, মাদ্রাসা, আশ্রয়কেন্দ্র এবং হাজার হাজার একর ওয়াকফ জমির ব্যবস্থাপনা একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বলছে, ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং আইনটির সংস্কারে মুসলিমদের দাবির প্রেক্ষিতেই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। তবে মুসলিম গোষ্ঠী এবং বিরোধী দল এসব সংশোধনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করতে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে। আর এ কারণে তারা এই সংশোধনীর বিরোধিতা করছেন।
বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের প্রতিবাদে কলকাতা-চেন্নাইতে বিক্ষোভ : ভারতের লোকসভায় বিতর্কিত মুসলিম ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাসের প্রতিবাদে গত শুক্রবার কলকাতা, চেন্নাই ও আহমেদাবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। জুমার নামাজ শেষে মুসলিম সমপ্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষোভকারীরা জাতীয় পতাকা ও প্লাকার্ড নিয়ে ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল প্রত্যাখ্যান’ স্লোগান দেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। কলকাতায় ‘জয়েন্ট ফোরাম ফর ওয়াকফ প্রোটেকশন’-এর ডাকে বিক্ষোভ হয়। বার্তা সংস্থা এএনআই-এর ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষোভস্থলে উন্মুক্ত স্থানে জমায়েত হয়ে বক্তারা বিলটির বিরোধিতা করেন। আহমেদাবাদে পরিস্থিতি বেশি উত্তপ্ত ছিল। পুলিশ সেখানে রাস্তায় অবস্থান নেয়া বয়োজ্যেষ্ঠ বিক্ষোভকারীদের জোর করে সরানোর চেষ্টা করে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর গুজরাট শাখার প্রধানসহ ৪০ জনকে আটক করা হয়।
চেন্নাইতে অভিনেতা বিজয়ের তামিলাগা ভেট্রি কাজাগাম (টিভিকে) রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দেয়। চেন্নাই, কোয়েম্বাটুর ও তিরুচিরাপল্লীতে টিভিকে কর্মীরা ‘ওয়াকফ বিল প্রত্যাখ্যান’ ও ‘মুসলিমদের অধিকার কেড়ো না’ স্লোগান দেন। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে দেখা হচ্ছে বিজয়কে। তিনি এই বিলকে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। লখনউতেও উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ডেপুটি কমিশনার অব পুলিশ (সেন্ট্রাল লখনউ) আশীষ শ্রীবাস্তব বলেন, আমরা সবাইকে বিলটি ভালোভাবে পড়ে মতামত দিতে বলেছি। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়মিত মনিটর করছি আমরা।
বাড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা : পশ্চিমবঙ্গে আগামী বছর নির্বাচনের মুখে এই বিক্ষোভ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতোমধ্যে বলেছেন, তিনি রাজ্যের মুসলিমদের জমি হারাতে দেবেন না। বিজেপিকে দেশ বিভক্ত করার চেষ্টার অভিযোগ এনে তিনি বলেছেন, নতুন অ-বিজেপি সরকার কেন্দ্রে গঠিত হলে এই বিল বাতিল করা হবে। বিক্ষোভকারীদের প্রধান উদ্বেগ, নতুন ওয়াকফ আইন প্রযোজ্য হলে তা বিদ্যমান সম্পত্তিগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়কমন্ত্রী কিরেন রিজিজু পার্লামেন্টে বলেছেন, আইনটি ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্য হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও তাকে সমর্থন জানিয়েছেন।
বিতর্কিত ওয়াকফ বিল যত ভোটে পাস : মুসলিমদের ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণকারী ওয়াকফ আইনে বড় ধরনের সংশোধনী এনেছে এই বিল। প্রায় ২০ ঘণ্টার তর্ক-বিতর্কের পর লোকসভায় এটি পাস হয়। বিরোধীরা এটিকে ‘মুসলিমবিরোধী’ আখ্যা দিলেও সরকারি দলগুলো একে ‘ঐতিহাসিক সংস্কার’ বলে অভিহিত করেছে। বিলটি লোকসভায় ২৮৮-২৩২ এবং রাজ্যসভায় ১২৮-৯৫ ভোটে পাস হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলেই এটি আইনে পরিণত হবে।
বিলের মূল পরিবর্তনগুলো : রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দুইজন অমুসলিম সদস্য নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দানকারীদের কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে অনুশীলনকারী মুসলিম হওয়ার প্রশংসাপত্র দিতে হবে। মুসলিম সমপ্রদায় ও বিরোধীদের আশঙ্কা, এই সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্র ওয়াকফ বোর্ডগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। তবে রিজিজু এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।
কী আছে সংশোধিত বিলে : ওয়াকফ সম্পত্তির মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি মুসলিমদের দান করা হাজার হাজার একর জমি আছে। ওয়াকফ বোর্ড এসব সম্পত্তির দেখভাল করে। এর মধ্য কিছু সম্পত্তি খালি পড়ে আছে, কিছু আবার আছে অন্যদের দখলে। ইসলামিক রীতি অনুযায়ী, ওয়াকফ সম্পত্তি হলো মুসলিম সমপ্রদায়ের কল্যাণে মুসলমানদের দেয়া দাতব্য বা ধর্মীয় দান। এসব সম্পত্তি বিক্রি করা যায় না, কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহারও করা যায় না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, ভারতে এখন সবচেয়ে বেশি জমির মালিক যারা, তাদের মধ্যে ওয়াকফ বোর্ডগুলো রয়েছে। তাদের হিসাবে ভারতজুড়ে অন্তত আট লাখ ৭২ হাজার ৩৫১টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যার আওতায় আছে ৯ লাখ ৪০ হাজার একর জমি। সব ওয়াকফ সম্পত্তির আনুমানির মূল্য প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি রুপি। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে, কোনটা হবে না সরকারকে তা নির্ধারণের এখতিয়ার দেয়ার কথাও বলা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
তবে বৃহস্পতিবার লোকসভায় অমিত শাহ বলেছেন, সংশোধিত বিলে ওয়াকফ বোর্ডে কোনো অমুসলিম রাখার কথা বলা হয়নি। ‘একজন মুসলিম তো চ্যারিটি কমিশনার হতেই পারেন। তাকে ট্রাস্ট দেখতে হবে না, আইন অনুযায়ী ট্রাস্ট কীভাবে চলবে, সেটা দেখতে হবে। এটা ধর্মের কাজ নয়। এটা প্রশাসনিক কাজ। সব ট্রাস্টের জন্য কি আলাদা আলাদা কমিশনার থাকবে? আপনারা তো দেশ ভাগ করে দিচ্ছেন। আমি মুসলিম ভাই-বোনদের স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনাদের ওয়াকফ বোর্ডে কোনো অমুসলিম থাকবে না। এই আইনে এমন কিছু নেই,’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে এমনটাই বলেছেন বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার।
পার্লামেন্টে তীব্র বিতর্ক : কংগ্রেস সংসদ সদস্য সোনিয়া গান্ধী এই বিলকে সংবিধানের ওপর ‘স্পষ্ট আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বিজেপি সমাজকে ‘স্থায়ীভাবে বিভক্ত’ রাখতে চায়। বিজেপি তার এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে। পার্লামেন্টে এই বিল নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডা হয়। রাজ্যসভায় রেকর্ড ১৭ ঘণ্টা ২ মিনিট এবং লোকসভায় ১২ ঘণ্টার বেশি আলোচনা হয়।
নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে ভারতের মুসলমানরা : ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ পাসের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। বিজেপি সরকারের এই মুসলিমবিদ্বেষী তৎপরতায় দেশটির মুসলমান জনগোষ্ঠী আরও ক্ষমতাহীন ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেছে দলটি। গতকাল শনিবার বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক বিবৃতিতে একথা বলেন। এতে বলা হয়, ভারতের লোকসভার ওয়াকফ বিল ভারতের সংবিধানবিরোধী ও ফেডারেল কাঠামোর পরিপন্থী। ভারতের মুসলমানদের আরও নিঃস্ব করতেই লোকসভায় ওয়াকফ বিল পাস করানো হয়েছে।
বিবৃতিতে সাইফুল হক বলেন, ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আরও ক্ষমতাহীন ও বিপদগ্রস্ত করতেই যে লোকসভায় এই বিল পাস করানো হয়েছে- তা স্পষ্ট। ভারতের বিরোধী দলগুলো ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতার মুখে পাস হওয়া এই বিলের মাধ্যমে জমি-জিরাত সংক্রান্ত মুসলমানদের শত শত বছর ধরে চলে আসা স্থাবর সম্পত্তির ওপর গুরুতর আঘাত। তিনি বলেন, এই বিল একদিকে ভারতের সংবিধানবিরোধী, আর অন্যদিকে মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মাচারণের পরিপন্থী। এই বিল ভারতের ফেডারেল কাঠামোর ওপরও বড় আঘাত। এই বিলের মধ্যদিয়ে রাজ্যের অধিকার খর্ব করা হলো। এই বিলের মাধ্যমে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমরাও সদস্য হতে পারবেন, এমনকি তারা বোর্ডের প্রধান নির্বাহীও হতে পারবেন। এই বিলের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহারের ভিত্তিতে স্বত্বাধিকারী হওয়ার বিধানও বাস্তবে বাতিল হয়ে যাবে। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, ওয়াকফ বিল হচ্ছে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির সরকার কর্তৃক ভারতের মুসলমানদের নিঃস্ব করার আগ্রাসী তৎপরতার অংশ। বিবৃতিতে তিনি মুসলমানবিদ্বেষী ও বিভক্তি-বিভাজন সৃষ্টিকারী এসব অশুভ তৎপরতা থেকে সরে আসতে বিজেপি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিল পাসের নিন্দায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস : ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ পাসের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে তারা বলেন, এই বিলটি মুসলিম সমপ্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার, ঐতিহাসিক আমানত এবং সাংবিধানিক সুরক্ষার বিরুদ্ধে এক ন্যক্কারজনক হস্তক্ষেপ। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের (মূলত হিন্দুদের) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে কোনটা হবে না সরকারকে— তা নির্ধারণের কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ ওয়াকফকৃত সম্পদ পরিচালনা ও ভোগের একমাত্র হকদার মুসলমানরা। এই বিলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওয়াকফ আইনকে দুর্বল করে দেয়া এবং ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও দখল করার আইনি পথ তৈরি করা।
তারা বলেন, মুসলমানরাই হলো ভারতের নির্মাতা। এই ভারত যা কিছু নিয়ে গর্ব করে তার প্রায় সবগুলোই মুসলিম শাসকদের অবদান। ৩০ কোটির বেশি মুসলিমের এই ভারতে বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। প্রায় ৯ লাখ স্থাপনা রয়েছে, যাতে জমির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ একর। এসব সম্পদের দাম প্রায় দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
শহর ও নগর এলাকায় ওয়াকফ বোর্ড হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে বেশি জমির মালিক প্রতিষ্ঠান। আর সব মিলিয়ে হিসাব করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ভূমির মালিক হচ্ছে মুসলমানদের এই প্রতিষ্ঠান। হিন্দুত্ববাদী উগ্র বিজেপি এই সম্পত্তির প্রতি আজন্ম লোভ লালন করে আসছে। এরা ইতোমধ্যে ভারতের একাধিক স্থানে মন্দিরসহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের জন্য ওয়াকফকৃত মুসলিম সম্পত্তি জবরদখল ও অবৈধ অধিগ্রহণ করেছে।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ওয়াকফ সম্পত্তি কেবল জমি আর স্থাপনা নয়- এটি মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাস, ইতিহাস এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি। এই সম্পদ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও গরিব-দুঃখীদের কল্যাণে ব্যবহূত হয়ে আসছে। পাসকৃত সংশোধনী এই সম্পদের ব্যবস্থাপনায় হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সরকারকে আইনি ক্ষমতা প্রদান করে, যা সংবিধানের সংখ্যালঘু অধিকার ও তথাকথিত ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থীও বটে। তারা আরও বলেন, আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলছি, মুসলিমবিদ্বেষী বিজেপি কর্তৃক ওয়াকফ বোর্ডের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরেকটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। বিবৃতিতে নেতারা বলেন, এই বিল ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অবিচার এবং সামাজিক ঐক্যের পরিপন্থী। ভারত সরকারকে অবিলম্বে ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ বাতিল করতে হবে। ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বায়ত্তশাসন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মুসলমানদের মতামত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত আরোপ করা চলবে না।
ভারত সরকারের অব্যাহত মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি নেতারা বলেন, ইসলামবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সরকারের এমন কর্মকাণ্ডে যেকোনো সময় বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারকে নির্যাতিত ভারতীয় মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ফোরামে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিবর্তনমূলক আইনের ব্যাপারে সরব প্রতিবাদ জানানো দরকার। বিবৃতিতে তারা বিশ্বের সব ইসলামি শক্তি, মানবাধিকার সংস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সচেতন নাগরিকদের এই বিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস : রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই ভারতে মুসলিম স্বার্থবিরোধী ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। গোলাম পরওয়ার বলেন, সংশোধনী বিলে ওয়াকফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম দুজন সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হয়ে যাবে, যা মুসলমানদের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নগ্ন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বাড়বে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই এই বিল পাস করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভারতে মুসলিম স্বার্থবিরোধী ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস ও বিজেপি সরকারের ধারাবাহিক মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। গত ৩ এপ্রিল ভারতের লোকসভায় পাসকৃত বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, মালিকানা ও অধিকার হরণে বিজেপি সরকারের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার আরেকটি ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। এই আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের দানকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রের মতো ধর্মীয় সম্পদগুলোতে সরকারি হস্তক্ষেপ ও দখলের পথ তৈরি করা হয়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, বর্তমানে ভারতে ২৫ কোটির বেশি মুসলমানের বসবাস। ভারতে হাজার বছরের পুরনো মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নানা কূটকৌশলে ধ্বংস করা হচ্ছে। মুসলমানদের অন্যতম শরিয়তের বিধান ‘তিন তালাক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লাভ ম্যারিজের নামে ধর্মান্তর প্রক্রিয়াকে সীমিত করা হয়েছে। গরুর গোশত রাখার অজুহাতে মুসলমানদের প্রায়ই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভারতের বিজেপি সরকারের এসব কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করা তারা চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তিনি বলেন, আমরা ভারতের বিজেপি সরকারকে এসব মুসলিম বিদ্বেষী অপতৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে আশা প্রকাশ করছি যে, তারা ভারতের মুসলমানদের জীবন, সহায়-সম্পত্তিসহ সব স্বার্থরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তাদের নিরাপত্তা বিধানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।