টালমাটাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ১২:০৫ এএম
টালমাটাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
  • শুল্ক আরোপের পর ৩ মাসের জন্য স্থগিত যুক্তরাষ্ট্রের

  • হঠাৎ ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল ভারত

  • পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আসছেন, আসবেন মন্ত্রীও

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পরিস্থিতি যখন ধীরে ধীরে উন্নতির পথে। দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভাণ্ডার ভারী করে তুলেছেন ঠিক তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক-পাল্টা শুল্ক আরোপ খেলা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য বাংলাদেশসহ ৭৫টিরও বেশি দেশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে পূর্বের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন।

তবে চীনের বিষয়ে অনঢ় অবস্থানে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এদিকে, ভারত ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দিয়ে আসছিল। এতে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর ও কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। হঠাৎ করে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) গত বুধবার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের আদেশ জারি করে। এতে আঞ্চলিক বাণিজ্যে নয়া শঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভারতীয় বিশ্লেষকরা। ৯ এপ্রিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে এমন শঙ্কার কথা জানানো হয়। তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।

তিনি বলেন, ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। এদিকে, বাংলাদেশের জন্য নতুন খবর হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে বাণ্যিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ফের শুরু হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে দেশটি পররাষ্ট্র সচিব আসছেন ঢাকায়, তার সফরের পরপরই দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।

২০২০ সালের ২৯ জুনের এক আদেশ, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বা ক্লোজ-বডি ট্রাক ভারতীয় স্থল কাস্টম স্টেশন ব্যবহার করে সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের পথে পাঠানো যেত, সেটি এখন বাতিল করা হয়েছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ভারতের গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রধান এবং সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ভারত গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জন্য একতরফাভাবে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের লালমনিরহাটে চীনের সহায়তায় একটি বিমানঘাঁটি পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা এবং চিকেন নেক করিডোরের কাছে একটি কৌশলগত ঘাঁটি তৈরির প্রচেষ্টা এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত ভারতের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলতে পারে। ডব্লিউটিওর গ্যাট ১৯৯৪-এর ধারা ৫ অনুযায়ী, সব সদস্য দেশকে স্থলবেষ্টিত দেশের পণ্যের মুক্ত ট্রানজিট সুবিধা দিতে হয়। ট্রানজিটে দেরি করা, অপ্রয়োজনীয় বাধা সৃষ্টি করা কিংবা অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা নিষিদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক স্থগিত ইইউর

শুল্কনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আকস্মিক অবস্থান পরিবর্তনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। গতকাল ইইউ ঘোষণা দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর পরিকল্পিত পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করছে। গত মাস থেকে ইউরোপের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করে ট্রাম্প প্রশাসন। এর জবাবেই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর একই হারে শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করে ইইউ। তবে নতুন শুল্কের আওতা থেকে বাদ রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বোরবন হুইস্কিকে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন বলেন, আমাদের সদস্য দেশগুলোর দৃঢ় সমর্থনের ভিত্তিতে ইইউ যে পাল্টা শুল্ক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা আমরা এখন ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখছি। আলোচনার জন্য আমরা এই সময়টুকু দিচ্ছি। তিনি আরও জানান, যদি আলোচনার ফল সন্তোষজনক না হয়, তবে আমাদের পাল্টা পদক্ষেপ কার্যকর করা হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইইউয়ের এই সিদ্ধান্ত কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর একটি কৌশল হতে পারে, তবে তারা নিজেদের অবস্থান থেকেও সরছে না। এই শুল্ক ইস্যু নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলোর কিছু পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিলে ইইউও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়। আর তাতেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে ?শুরু করে। বাণিজ্য যুদ্ধ ও পাল্টা শুল্কের কারণে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এমন উত্তেজনার ফলে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলেও স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি

ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে কোনো প্রভাব পড়েনি দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায়। অন্য দিনের মতো গতকাল বৃহস্পতিবারও এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। গতকাল বিকালে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গতকাল নেপাল ও ভুটান থেকে অন্যদিনের মতোই এসেছে বোল্ডার পাথর, সুগার মোলাসিস, অর্গানিক রংসহ অন্যান্য পণ্য। ৪৩টি পণ্যবাহী ট্রাকে এক হাজার ২৪০ টন পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল, আলু, টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য পণ্যের ২২টি ট্রাকে ৪৮৩ টন পণ্য যায় নেপালে।

স্থলবন্দর সূত্র জানায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে নেপালে নিয়মিত আলু রপ্তানি করা হচ্ছে। ৯ এপ্রিল ৩১৫ মেট্রিক টন আলু নেপালে রপ্তানি করা হয়। গত দুই মাসে থিংকস টু সাপ্লাই, হুসেন এন্টারপ্রাইজ, স্বাধীন এন্টারপ্রাইজ ও ক্রসেস এগ্রো নামে চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এই স্থলবন্দর দিয়ে কয়েক দফায় তিন হাজার ১৫০ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি করে নেপালে। স্থলবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের সঙ্গনিরোধ পরিদর্শক উজ্জ্বল হোসেন বলেন, রপ্তানিকারক চারটি প্রতিষ্ঠান রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আলুগুলো সংগ্রহ করে নেপালে পাঠায়। সবশেষ গতকাল বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হয়েছে নেপালে।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের স্থলবন্দরে আপাতত আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি তেমন কোনো নির্দেশনা আসেনি। গতকালও আমাদের এই বন্দর দিয়ে বিভিন্ন পণ্য ভারত ও নেপালের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিনের মতো গতকালও আমরা কাজ করেছি।’

বন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারকসহ ব্যবসায়ীদের জানাতে চাই, আমাদের এখানে কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিকভাবেই পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না। গত ৯ এপ্রিল ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল ইস্যুতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কার্যালয়ে আয়োজিত এক বৈঠক শেষে তিনি এ কথা জানান। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানির যে প্রক্রিয়া, তাতে এ সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে।

শুল্ক স্থগিত, চীনের ব্যাপারে অনঢ় ট্রাম্প

সম্প্রতি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ওপর পালটা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে চীনকে বাদ রেখে বাকি সব দেশের ক্ষেত্রে সেই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন তিনি। সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প নমনীয় হলেও চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক ১০৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্থানীয় সময় গত বুধবার ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, বিশ্বের সব দেশের ওপর শুল্ক কার্যকর করার সিদ্ধান্তে ৯০ দিনের বিরতি থাকবে। শুধু চীনের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ট্রাম্পের দাবি, ৭৫টিরও বেশি দেশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আলোচনায় বসেছে। তাই ৯০ দিনের এই বিরতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সময়ে একটি হ্রাসকৃত অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিশোধমূলক ট্যারিফ চালু থাকবে। তবে চীনের বিষয়ে ট্রাম্প জানান, সর্বশেষ ১০৪ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি করে ১২৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘বিশ্ববাজারের প্রতি চীনের অসম্মানজনক আচরণের জবাবে আমরা এই পদক্ষেপ নিচ্ছি’।

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘চীন চুক্তি করতে চায়। কিন্তু ঠিক কোন পথে তা করতে হবে, তা তারা জানে না... তবে তারা এটা বুঝে নেবে। আশা করি খুব শীঘ্রই চীন বুঝবে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে ঠকিয়ে চলা আর টেকসই নয় এবং এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়’। ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ট্রাম্প অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সমস্ত দেশকে জানিয়েছিলাম, পালটা ব্যবস্থা না নিলে তোমরা পুরস্কৃত হবে। সুতরাং, যারা আলোচনায় আসতে চায়, আমরা তাদের কথা শুনতে প্রস্তুত।

কেন এই বিরতি

এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পের দলের অভ্যন্তরীণ চাপ ও ব্যবসায়িক মহল থেকে ট্যারিফ বন্ধের অনুরোধ আসছিল। কারণ, এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ ও মন্দার আশঙ্কা তৈরি করেছিল। তবু ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমার নীতিতে পরিবর্তন আসবে না’। তবে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ে উদ্বেগ বেড়ে ওঠে, বিশেষ করে বন্ড মার্কেট নিয়ে। আর এটাই শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পকে তার সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে বাধ্য করেছে। 
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এবং হোয়াইট হাউজের অর্থনৈতিক কর্মকর্তারা তাকে মার্কেট পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। ট্রাম্প পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্ড মার্কেট জটিল জিনিস... আমরা এটা হূদয় থেকে লিখেছি, আইনজীবীর পরামর্শ ছাড়াই’।

বেসেন্ট বলেন, এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয় যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেন এবং আমরা সৎভাবে আলোচনা করতে চাই। বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক জানান, ট্রাম্প যখন ট্রুথ সোশ্যাল-এ এই বার্তাটি লিখেছিলেন, তখন তিনি এবং বেসেন্ট তার সঙ্গে ছিলেন। লুটনিক বলেন, স্কট বেসেন্ট এবং আমি প্রেসিডেন্টের পাশে বসে ছিলাম, যখন তিনি তার প্রেসিডেন্সির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ট্রুথ পোস্টটি লেখেন। বিশ্ব এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত, কিন্তু চীন ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে।

শেয়ারবাজারে প্রতিক্রিয়া

এদিকে ট্রাম্পের সর্বশেষ এই ঘোষণার পরপরই ওয়াল স্ট্রিটে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বগামী হয়ে ওঠে। ডাও জোন্স সূচক প্রায় ২,৫০০ পয়েন্ট বেড়ে যায়, যা ৮ শতাংশ বৃদ্ধির সমান। নাসডাক ১২.২ শতাংশ বেড়ে ২৪ বছরের মধ্যে সেরা পারফরম্যান্স করে এবং এস অ্যান্ড পি ৫০০ সূচক ৬ শতাংশ বেড়ে ৫,২৮১.৪৪ পয়েন্টে পৌঁছায়। তেল ও ডলারের দামও বেড়ে গেছে। যার ফলে বৈশ্বিক বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে।
ভারতের পরিস্থিতি কী

এদিকে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের পর থেকে ভারতের বাজারে প্রভাব পড়ে। কিন্তু এই ৯০ দিনের বিরতির ফলে ভারতের বাজারে স্বস্তি আসবে এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য সময় পাওয়া যাবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বহুস্তরীয় বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চলছে এবং আমরা আশা করছি শীঘ্রই এই আলোচনা সফলভাবে শেষ হবে’। তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি’।
পাল্টা শুল্ক স্থগিত করায় ট্রাম্পকে প্রধান উপদেষ্টার ধন্যবাদ

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করায় দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গত বুধবার দিবাগত রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট মেনশন করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করতে আমরা যে অনুরোধ করেছিলাম, তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়ায় প্রেসিডেন্ট আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার বাণিজ্য এজেন্ডার সমর্থনে আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করা অব্যাহত রাখব আমরা।’

যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল, বুধবার রাতে তা তিন মাসের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এই ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প বলেন, এই সময় দেশগুলোর পণ্যে পাল্টা শুল্ক ন্যূনতম ১০ শতাংশ কার্যকর হবে। তবে চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ করে সোমবার ট্রাম্পকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশে শুল্ক-সুবিধা দেয়ার কথাও বলেন। এ ছাড়া গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর, চিকিৎসাসামগ্রীর মতো বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমানোর কথা বলেন তিনি।

ট্রাম্পকে পাঠানো চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা আগামী প্রান্তিকের মধ্যে আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ শেষ করব। এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শক সভার জন্য দয়া করে প্রয়োজনীয় সময় দেবেন। তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করতে চাই যে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করুন। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আপনি আমাদের অনুরোধ রাখবেন।’

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আসছেন, আসবেন মন্ত্রীও

প্রায় দেড় দশক পর বাংলাদেশের সঙ্গে স্থবির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে পাকিস্তান। ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংযুক্তিকে বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এ উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচের ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করেছেন। তার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার পর সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে পাঁচ দিনের মাথায় ঢাকায় আসবেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যে। সূত্রে জানা গেছে, আমনা বেলোচের এ সফর মূলত দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক পরামর্শ বা ফরেন সেক্রেটারি লেভেল কনসালটেশনের অংশ হিসেবে হচ্ছে। এ সফর দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় ও বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।

অপরদিকে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, আগামী ১৭ এপ্রিল ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বেলোচের সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। প্রায় ১৫ বছরের বিরতিতে অনুষ্ঠেয় এই বৈঠকে দুই দেশের সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সম্পর্কের নানা বিষয় আলোচনার সময় ঐতিহাসিক অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোও আলোচনায় আসবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার চলতি মাসেই ঢাকা সফরে আসছেন।

তিনি বলেন, তাদের সফর নিশ্চিত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তার সফরের তারিখ জানাবেন। পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সব দিক নিয়েই আলোচনা করব। ইসহাক দারের এই ঢাকা সফর হবে ২০১২ সালের পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।