যমুনায় বৈঠকের পর আশাহত বিএনপি
রোজার আগেই নির্বাচন চায় জামায়াত
সংস্কারহীন নির্বাচনে সংশয়ে এনসিপি
জুলাইয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করবে ইসি
সম্ভাব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠিক কখন হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংশয় কাটেনি। সুস্পষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ চাইতে গতকাল যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাত করে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। ওই সাক্ষাতে সরকার প্রধানের বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি দলটি। কয়েকদিন আগে দ্রুত নির্বাচন চাইলে সংস্কার কাজের গতি বাড়াতে প্রধান উপদেষ্টা তাগিদ দিলেও তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়নি ঠিক কখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ভোট চেয়েছে আগামী রোজার আগে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর রোজা শুরু হবে। সে হিসাবে জামায়াত ভোট চায় ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে। সরকারের প্রধান নির্বাহী বেশ কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন আগামী ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ভোট হবে।
বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হোক। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনই নির্বাচন চান না, তারা চান মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচন। তাদের দাবি প্রথমে গণহত্যার বিচার, এরপর মৌলিক সংস্কার এবং তারপর গণপরিষদ নির্বাচন। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এনসিপি তাতে অংশ নাও নিতে পারে এমন ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে।
বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি এই তিনটি দলের অবস্থান পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি দৃষ্টিতে আসে তা হচ্ছে- নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত প্রায় একই গতিপথে অবস্থান করছে। এই দুটি দলের দাবির মধ্যে পার্থক্য মাত্র এক-দেড়মাস। কিন্তু এনসিপি গণহত্যার বিচার ও মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচন চায়, যা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর এই অবস্থানের মধ্যে গতকাল একজন নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন আগামী জুলাই মাসেই নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় আশাহত বিএনপি
জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ জানতে গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিএনপি। কিন্তু ওই বৈঠক শেষে বিএনপি সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কোনো (নির্বাচনের) সুনির্দিষ্ট ডেডলাইন আমাদের দেননি। তিনি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
তিনি বলেন, ডিসেম্বর হলো তাদের কাটঅফ টাইম। ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। তখন সেটি নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।
ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন এই যে সময় এখন প্রধান উপদেষ্টা দিলেন এতে কি সময় প্রলম্বিত হচ্ছে বলে মনে করেন কিনা জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) ডিসেম্বর থেকে জুন বলেছেন, উনি এই কথা বলেননি যে, এটা ডিসেম্বরে হবে না। কিন্তু জুন পর্যন্ত নিয়েছেন। আমরা এই কথাটা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি যে, আমাদের কাটঅফ টাইম হলো ডিসেম্বর।
রোজার আগেই নির্বাচন চায় জামায়াত
নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয় জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির শফিকুর রহমান বর্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা মাথায় রেখে আগামী রোজার আগেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন করার পক্ষে নিজের দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
গতকাল মার্কিন ডেপুটি হেড অব মিশনের বাসভবনে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াত। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দলটির আমির নির্বাচন নিয়ে দলের এই অবস্থান বৈঠকে তুলে ধরার কথা জানান।
জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা রমজানের আগেই শেষ হয়ে যাক। ওই জুন পর্যন্ত অপেক্ষা, কখন বর্ষা, ঝড়ঝাপটা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা না হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাবে। তাই আমরা চাচ্ছি, ওই আশঙ্কার আগেই, রমজানের আগেই এইটা হয়ে যায়, সেটা আমাদের মতামত।’
একজন সাংবাদিক জানতে চান, জামায়াত তাহলে আগামী রোজার আগেই নির্বাচন চাইছে কি না— জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, ‘হ্যাঁ। শুধু আগামী না। আগামী অনেক রোজাই আসবে। আগামী প্রথম রমজানের আগেই।’
সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয়ে এনসিপি
ঢাকায় সফররত মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে গতকাল বিকালে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময় তিনি বলেন, ন্যূনতম সংস্কার নয় বরং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের জন্য কাজ করছি। এই পরিবর্তনগুলো ছাড়া নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সেই নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কিনা, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।
তিনি বলেন, প্রশাসন দেখছি বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে। মাঠ পর্যায়ে যে চাঁদাবাজি চলছে সেখানেও প্রশাসন নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। আমরা বলেছি এ ধরনের প্রশাসন থাকলে এর অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন, পুলিশ, আমলাতন্ত্র আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের যে তিনটি দাবি বিচার, সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচন; সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছি।
জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকারের অবস্থান
নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে যমুনায় প্রবেশ করে বিএনপির প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে দুপুর ২টার দিকে বিএনপির প্রতিনিধি দল যমুনা থেকে বের হয়ে আসে। এরপর সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে ভালো হয় বলে জানিয়েছে।
তারা বলেছে, আমাদের উপদেষ্টাদের অস্পষ্ট কথা থাকে, আমাদের সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা অন্যরকম কথা বলেন। যে যেটাই বলুক না কেন, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে বারবার যে কথা বলেছেন, সেটাই আমাদের অবস্থান। অন্য কেউ যদি বেফাঁস কথা বলেন তারা যেন বিভ্রান্ত না হন।
আলোচনায় কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিসেম্বর থেকে জুন মাস, মানে আমরা ইচ্ছা করেই দেরি করে মে মাসে নির্বাচন করব, এমনটা নয়। ডিসেম্বর থেকে জুন মানে হচ্ছে ডিসেম্বরের পর থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন করা। আমরা অকারণে এক মাস, দুই মাস বেশি থাকলাম, মোটেও এমনটা নয়। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন হবে।
জুলাইয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে চায় ইসি
গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। সে সময় তিনি জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ আগামী জুলাই মাসে ঘোষণা করা হবে। ইসি আনোয়ারুল বলেন, তফসিল ঘোষণার আগে যেসব তরুণের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তবে বিদ্যমান আইন দিয়ে হবে না। এ জন্য আইন পর্যালোচনা করে সংশোধন করা হবে। এমন উদ্যোগ প্রথমবারের মতো নেয়া হচ্ছে।
দেশের বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বেশকিছু জেলা ভিজিট করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলেছেন, তারা আরও ইম্প্রুভ করবেন। আইনশৃঙ্খলা প্রতিদিন উন্নত হচ্ছে। আপনারা দেখে থাকবেন, আগের তুলনায় বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব পদক্ষেপ নেয়া হবে।
নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ভোটার তালিকা অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ ঘরে ঘরে গিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছে, আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের টার্গেট ছিল ৬১ লাখ ৮৮ হাজার নতুন ভোটার নিবন্ধিত হবে। দেখা যাচ্ছে, ৪৩ লাখের ওপরে বাদ পড়া ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে, নতুন হয়েছে ১৯ লাখ ৬৬ হাজার। মোট ৬৩ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে। আমরা আশা করি জুনের মধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকাটি পেয়ে যাব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তফসিল ঘোষণার আগে অনেকের বয়স ১৮ হবে। তারাও ভোট দিতে চায়, এবার এই তরুণরা নতুন ভোটার হবে। নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ হবে তাদের যেন আমরা ভোটার তালিকায় যুক্ত করতে পারি এবং তারা যেন ভোট দিতে পারে।