লক্ষ্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও দুই দেশের নিরাপত্তা ইস্যু
ইতিবাচক দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা
পূর্বের পাওনা দাবি ও একাত্তরের ঘটনায় ক্ষমা চাইতে বলেছে ঢাকা
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে মনোযোগী পাকিস্তান। শুধু বাণ্যিজ্যিক সম্পর্ক নয়, দুই দেশের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে সেগুলো সমাধানের পথও খুলবে। দীর্ঘ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে বন্ধ ছিল বাণিজ্যক সম্পর্ক। কিন্তু এখন ঢাকা ও ইসলামাবাদ উভয়ই মনে করে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাণিজ্যে পিছিয়ে থাকতে না চাইলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করার বিকল্প নেই। আর এমন বাস্তবতায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকায়।
সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে এ মাসেই ঢাকা আসছেন পকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা দুই দেশের এমন মনোভাবকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনার প্ল্যাটফর্ম ফরেন অফিস কনসালটেশন বা এফওসি বৈঠকে ইসলামাবাদের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ। অন্যদিকে, ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আলোচনা শে?ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে বিকালে উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ ক?রেন বালুচ।
বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে গতকাল বিকাল পর্যন্ত কিছুই জানা না গেলেও পারস্পরিক বোঝাপড়া আর রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে উভয়পক্ষের জন্য বৈঠকটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে আমনা বালুচ বলেন, ঢাকায় এসে আমি খুশি। খাবার ভালো ছিল ও শপিং ভালো হয়েছে। আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়েছে।
গতকালকের বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেছে বাংলাদেশ। এছাড়া স্বাধীনতা পূর্ব সম্পদ হিসেবে ৪২০ কোটি ডলার ফেরত চেয়েছে ঢাকা। এ নিয়ে ইসলামাবাদ আলোচনায় রাজি হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়া ভবিষ্যতে দুই দেশের যোগাযোগ বাড়িয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে আলোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ঢাকা ও ইসলামাবাদ। একইসঙ্গে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সব ধরনের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে উভয়পক্ষ।
এদিকে দীর্ঘ সময় পর দুই দেশের মধ্যে এমন আলোচনাকে ইতিবাচক অবস্থান থেকে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ইসলামাবাদের সঙ্গে ঢাকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে দুই দেশকেই মনোযোগী হতে হবে। এছাড়া আলোচনায় একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয়গুলোও আসতে পারে। ?আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক শাহাব এনাম বলেন, পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফর দেশের জন্য ইতিবাচক। অর্থনীতিকে যেহেতু আমরা গতিশীল করতে চাচ্ছি, তাই এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধসহ তাদের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও কথা বলা দরকার। এছাড়া সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। এতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি নিয়েও আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা আছে পাকিস্তানে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলা এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে ‘জট খোলা’ সম্পর্ককে এগিয়ে নিতেই এ বৈঠক। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, প্রায় ১৫ বছর পর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হলো। সুনির্দিষ্ট এজেন্ডায় সীমাবদ্ধ না থেকে দুই দেশের মধ্যকার ‘সব বিষয়ই’ এ বৈঠকে উঠেছে বলে সূত্রে জানা গেছে। বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বাংলা বলছে, দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘স্বাভাবিকীকরণের’ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে, যাতে গুরুত্ব পাবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বৈঠকের পর চলতি মাসেই পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ বিষয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন কাজ করছে। ২০১২ সালের পর বাংলাদেশে এটি হবে কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে সবশেষ বৈঠক হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ সালে। এরপর ধীরে ধীরে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী বিচার ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে বাংলাদেশের।
২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর উদ্বেগ জানিয়ে সংসদে প্রস্তাব পাস করেছিল পাকিস্তান। এ ঘটনায় ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে ডেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালেও এই বিচার নিয়ে পাকিস্তানে সেখানকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বক্তব্য নিয়েও ঢাকায় তখনকার পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার আহমেদ হুসাইন দায়োকে তলব করে প্রতিবাদ করেছিল সরকার। পরে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতির পরও ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনার সুজা আলমকে তলব করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, যা নিয়ে সরগরম হয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। কিন্তু সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে তখন আর অগ্রগতি হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের নভেম্বরে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এদিকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার চলতি মাসের শেষের দিকে ঢাকা সফর করবেন বলে জানা গেছে। ২০১২ সালের পর বাংলাদেশে এটিই হবে কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।