এখনো নাগালের বাইরে কারাগার থেকে পালানো বিপুলসংখ্যক বন্দি

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০২৫, ১২:১৯ এএম
এখনো নাগালের বাইরে কারাগার  থেকে পালানো বিপুলসংখ্যক বন্দি

এখনো নাগালের বাইরে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকালে কারাগার থেকে পালানো বিপুলসংখ্যক বন্দি। ওই সময় কয়েক হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে নরসিংদী কারাগারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করলে কারাগার থেকে ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যায়। তাদের মধ্য অতিঝুঁকিপূর্ণ ৯ জন আসামি রয়েছে। ওই সময় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

প্রাথমিকভাবে কারা কর্তৃপক্ষ ও রক্ষীরা প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হন এবং একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে কয়েদিদের সঙ্গে মিশে যান। তারপর সারা দেশে আরও ১৬টি কারাগারে বন্দি বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা ঘটে। তখন বিভিন্ন কারাগার থেকে দুই হাজার ২৩২ জন বন্দি পালিয়ে যায়।

১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১৭টি কারাগারের সংস্কার কাজ শেষে সেগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে এসেছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ৭০ জনসহ পালিয়ে যাওয়া এক-তৃতীয়াংশ বন্দিকে এখনো ফেরানো যায়নি। ফেরারি ওসব বন্দি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যদিও পলাতক বন্দিদের বিষয়ে কারা অধিদপ্তর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। কারা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের ১৭টি কারাগারে গত ৫ আগস্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বন্দিরা বিশৃঙ্খলা-বিদ্রোহ করে। পালিয়ে যায় নরসিংদী, শেরপুর ও সাতক্ষীরা কারাগারের সব বন্দি। নরসিংদী কারাগার থেকে ৮২৬ জন, শেরপুর থেকে ৫০০ জন, সাতক্ষীরা থেকে ৬০০, কুষ্টিয়া কারাগার থেকে ১০৫ ও কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়। তার বাইরে জামালপুর কারাগারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেখানে ঘটেনি বন্দি পালিয়ে যাওয়ার কোনো ঘটনা। সব মিলিয়ে দেশের কারাগার থেকে ওই সময় দুই হাজার ২৩২ জন বন্দি পালিয়ে যায়। পরে তাদের মধ্যে ফিরেও আসে এক হাজার ৪৫০ জন বন্দি। ফিরে আসা বন্দিদের মধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়া এবং জামিনে মুক্তি মিলিয়ে এক হাজার ১০০ জন এরই মধ্যে ছাড়া পেয়েছে এবং বাকি ৩৫০ জন এখনো কারাগারে রয়েছে।

সূত্র জানায়, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারকে দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে সর্বাধুনিক নিরাপত্তা প্রস্তুতিসংবলিত কারাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত ওই কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, একাধিক গুরুতর অপরাধে জড়িত, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদে জড়িত দুর্ধর্ষ বন্দিদের রাখা হয়। কিন্তু বিগত সরকারের পতনের পর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে থাকা বন্দিরা বিদ্রোহ করে। ওই সময় তারা কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কারারক্ষীরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে বন্দিরা তাদের ওপর চড়াও হয়। বন্দিদের কেউ দেয়াল ভেঙে, কেউ টপকে, আবার কেউ দেয়ালের সঙ্গে বিদ্যুতের পাইপ লাগিয়ে কারারক্ষীদের মারধর করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করে।

তবে বন্দিদের মধ্যে ২০৯ জন দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়। যদিও পালানোর সময় নিরাপত্তাকর্মীদের গুলিতে ছয়জনের মৃত্যু হয়। তারপর বিশৃঙ্খলা জামালপুর কারাগারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই কারাগারের কিছু কয়েদি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি শুরু করেন এবং পরে ১৩ কারারক্ষীকে জিম্মি ও মারধর করে কারাগারের ভেতরের ফটক ভেঙে পালানোর চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি ছুড়লে ছয়জন নিহত হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার গোলাগুলিতে কারা কর্মকর্তা ও বন্দিসহ আহত হয় ১৯ জন। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় জামালপুর কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে পারেননি কোনো বন্দি। তাছাড়া কয়েকশ লোক সাতক্ষীরা কারাগারের প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা প্রধান ফটকসহ কারাগারের সব সেলের তালা ভেঙে ৫৯৬ জন বন্দিকে বের করে নিয়ে যায়। পরে সাতক্ষীরা কারাগারের বিভিন্ন শ্রেণির অনেক বন্দি ফিরে এলেও এখনো দুই নারীসহ ৬৭ জন পলাতক। তাছাড়া শেরপুর জেলা কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ওই সুযোগে কারাগারটি থেকে ৫১৮ বন্দি পালিয়ে যায়।

সূত্র আরও জানায়, কারাগারগুলো থেকে পলাতক বন্দিদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হত্যা, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। বন্দিদের মধ্যে দুর্ধর্ষ ব্যক্তিরা আবার নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করতে পারে। কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়া বন্দিরা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য হুমকি। তারা বিভিন্ন রকম মামলার আসামি ছিলেন। এর ওপর যখন তারা জেল ভেঙে পালিয়েছে, তখন তারা আরও বেশি দাগি অপরাধী হয়ে উঠেছে। দেশের চলমান খুন, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধগুলোর পেছনে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জেল পালানো ওসব বন্দিকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

এদিকে কারা অধিদপ্তর দেশের সব কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে। ওই লক্ষ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় কারা প্রশাসনেও বেশকিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা ও বন্দিদের সব ধরনের প্রাপ্যতা বিধিবিধান নিশ্চিতেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারাবন্দি ও কর্মচারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারাবন্দি ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কারাগার ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সফটওয়্যারসহ, আরএফ আইডি এবং জিপিএস ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর সেবাপ্রত্যাশীদের সহায়তার জন্য নেয়া হয়েছে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালুর উদ্যোগ। 

কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তর করতে বন্দিদের প্রশিক্ষণসহ তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেজন্য বিজিএমইএর সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লাইন স্থাপনের কাজ চলছে।

অন্যদিকে বন্দি পালিয়ে যাওয়া বিষয়ে সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দেশের ১৭টি কারাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মধ্যে ছয়টি কারাগার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগারগুলো সংস্কার করে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। আর পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে এক হাজার ৪৫০ জন কারাগারে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ায় মুক্তি পেয়েছে, অনেকে জামিনেও মুক্তি পেয়েছে। তবে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে এখনো ফেরারি প্রায় ৭০০ বন্দি। তাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবে।