গড় মামলার হয়রানিতে পেশাজীবীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৫, ১২:১৩ এএম
গড় মামলার হয়রানিতে পেশাজীবীরা

জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতসহ বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত এক হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি। অন্যান্য ৯০০টি। এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যা মামলার মধ্যে অনেকগুলোর তদন্তে অগ্রগতি আছে বলেও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। তবে অধিকাংশ মামলাতেই অসঙ্গতির তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসঙ্গতির বিষয়, ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের চেয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অধিকাংশই নিরীহ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এতে গ্রেপ্তার নামে বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। যদিও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলছেন, এসব ঘটনার তদন্তে দায়ভার প্রমাণ না হওয়ার আগেই নিরীহ কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

গতকাল সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বলেন, নিরীহ কাউকে যেন গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করা হয়, পুলিশের সব স্তরে সেই নির্দেশনা দেয়া আছে। মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্তে যার দায়ভার পাওয়া যাবে, কেবল তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিরীহ মানুষকে হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা মিথ্যা নয়, মামলা সত্যই। তবে আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া এই জায়গাটা আমরা বন্ধ করতে পারছি না। আইনেও এই সীমাবদ্ধতা আমাদের রয়েছে।

আইজিপি বলেন, ৫ আগস্টের পর দেখা গেছে, অপরাধ হয়তো করেছেন পাঁচজন কি দশজন, কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্যে, অর্থ আদায়ের জন্য, কাউকে হয়রানি করার জন্য, ভয় দেখিয়ে ৩০০ লোকের নামে মামলা দিয়ে দিয়েছে। পুলিশ প্রধান বলেন, আমরা মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানির জায়গাটা বন্ধ করতে চাই। এ জন্য আমিও অনেক সময় থানায় ফোন দিয়ে কথা বলছি। আসামি করে হয়রানি করা হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি। আইজিপি বলেন, দেশবাসীকে অনুরোধ, আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন। তবে আমাদের কাছে যেন কোনো অন্যায় আবদার করা না হয়।

বিভিন্ন মামলার তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে জানা যায়, অধিকাংশ মামলার আগে-পরে নিরীহ আসামিদের কাছেও অর্থ দাবি ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পেশাগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকেও অনেককে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাদের স্বজনরা। অনেক আসামিকে বাদী নিজেই চেনেন না। পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশ সদস্যদের মনোবল দুর্বল থাকায় থানাগুলোতে যাচাই-বাছাই করে মামলা নেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশেও মামলা হয়েছে।

ঢালাও আসামি করার বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত জারি করতে হয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চাঁদাবাজি, ব্ল?্যাকমেল করাসহ নানা রকম হয়রানির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। এ ধরনের মামলা করার মাধ্যমে যারা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ ছাড়া হয়রানিমূলকভাবে যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না বলে সরকারের উচ্চপর্যায় ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে। এরপরও গ্রেপ্তার থামেনি। ব্যবসায়িক-প্রাতিষ্ঠানিক বা সম্পত্তিগত বিরোধের জেরেও আসামি হওয়া ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের জন্য প্রতিপক্ষ যেমন সক্রিয় থাকে, পাশাপাশি ‘বাণিজ্যের’ উদ্দেশ্যে করা আসামিদের ধরতে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশেরও বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ বা নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর হুমকি দিয়েও অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে। শুরুতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলা না করে খসড়া এজাহার দেখিয়েও অনেকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।  

এদিকে আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি হামলায় যারা ছিলেন, তাদের বড় অংশ এখনো ধরা পড়েনি। শহীদদের স্বজনরা প্রিয়জন হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি মামলায় এত বেশিসংখ্যক মানুষকে আসামি করা হয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করতেই তারা হিমশিম খাচ্ছেন।

পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, সারা দেশে ১০টি মেন্টরিং অ্যান্ড মনিটরিং দলের মাধ্যমে মামলাগুলো তদারক করা হচ্ছে। এর মধ্যে আট বিভাগে আটটি, রাজধানীতে একটি ও গাজীপুরের জন্য একটি দল করা হয়েছে। প্রতিটি দল নিয়ে মামলাগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এতে নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি করার ঘটনা কমে এসেছে। আইজিপি বলেন, আসামি যতই হোক, অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেয়া হবে।

বিভিন্ন মামলার সূত্রে জানা যায়, পেশাজীবী শ্রেণির মানুষদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হচ্ছে। একেক মামলায় একেক শ্রেণির ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। কোথাও সাংবাদিক, কোথাও ব্যবসায়ী, কোথাও আবার পুলিশ, কোথাও আমলা। 

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এমন মামলার আসামি একজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সাংবাদিক বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় পুলিশি তদন্তে আমার সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ। আন্দোলনের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম না। এর পক্ষে সব প্রমাণ উপস্থাপনের পরও ফের আরেকটি মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। এখন ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছে। পুলিশও সেই সুযোগ নিচ্ছে। এমন হয়রানি থেকে পরিত্রাণ মিলছে না। শুধু ওই সাংবাদিকই নয়, ব্যবসায়ী, আমলা পুলিশ কেউই এর থেকে বাদ যাচ্ছে না। শাহবাগ থানার ১০ কর্মকর্তাকেও একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক একজন সচিব জানান, মামলার পর থেকেই তার কাছে অর্থ দাবি করা হচ্ছে। একইভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও মামলা করেই দাবি করা হচ্ছে মোটা আঙ্কের চাঁদা।