ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ০৬:২৫ পিএম
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিশ্বের বুকে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করল আরেকটি ভূখন্ড, যার নাম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর এলেই দেশব্যাপী বিজয়ের ধ্বনি নতুন করে উচ্চারিত হয়। বিজয়ের এ উদযাপন তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করে তোলে।
স্বাধীনতার ৫১ বছরে দাঁড়িয়ে এ বাংলাদেশের আছে নানা অর্জন। যুদ্ধের সেই দিনগুলো কেমন কেটেছিল, কিভাবে দিন পাড় করেছিল জীবনবাজি রেখে চলা সেই লড়াকু সৈনিকরা। তা জানার লক্ষ্যে কথা হয় তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাদের স্মৃতিময় দিনগুলো লেখার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন মামুনূর রহমান হৃদয়।
* আমার কান ঘেঁষে একটি বুলেট বেড়িয়ে যায়
শেখ মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান। একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ৭৩ বছর বয়সী এই দেশপ্রেমিক জানান তার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প। তিনি বলেন, পাক হানাদার ও রাজাকার দ্বারা আমাদের গ্রাম আক্রান্ত হলে আমি আমার মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পাট ক্ষেতে আশ্রয় নেই। পরবর্তী সময়ে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ নৌকাযোগে প্রায় ২ মাইল দূরে একটি গ্রামে তারা আশ্রয় নেয়। আমি কারণ বশত নৌকায় উঠতে পারিনি। পরে আমাকে নেওয়ার জন্য আমার বাবা ও বড় কাকা দুজনে নদী সাতড়ে এসে বিলের মাঝে অবস্থান করেন। আমাকে নেওয়ার জন্য আমার ছোট কাকা তিতাস নদীর পাড়ে আসেন। তারপর আমি আমার কাকাসহ আরও ৯ জন নদীর পাড়ে হিন্দুদের শ্মশানে বৃহৎ গাছের আড়ালে আশ্রয় নেই। পরক্ষণেই সেখানে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারের আবির্ভাব হয়। কৌতূহল বশত আমি গাছের ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে দেখতে যাবো তখনি আমার কান ঘেঁষে একটি বুলেট বেড়িয়ে যায়। হানাদার বাহিনীরা আমাদের দেখতে পেয়ে আমার কাকাসহ তিনজনকে খাল পাড়ে উঠায়। এরপরেই বন্দুকের ব্যারেল দিয়ে আমার ছোট কাকাকে হত্যা করে। গুলি করে হত্যা করে আমার চাচাতো ভাই ও এক মামাসহ আরও দুজনকে। তারপর কোন এক সময়ে পাক হানাদার বাহিনীরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে একদা আমি ও আমার বড় ভাই যৌথভাবে এক রাজাকারের বাড়িতে দেশীয় অস্ত্র দ্বারা আক্রমণ করি । তখন রাজাকার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলে আমরা তার পিছু নেই। পথিমধ্যে বৃষ্টির জন্য রাস্তা পিচ্ছিল থাকায় আমার বড় ভাই মাটিতে পড়ে যায়। এই সুযোগে সেই রাজাকার পলায়ন করে এবং ভারতে পাড়ি জমায়। সে সময় সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে, দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থে আমি ভারতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নিজের আনুষ্ঠানিক নাম লেখাই এবং অস্ত্রশহ প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি।
* যুদ্ধের দশ মাস বড় ভাইয়ের খোঁজ পাইনি
যুদ্ধ করেছেন মানুষের অধিকারের জন্য, এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য । পরে নানা জটিলতায় পারেননি সার্টিফিকেট তুলতে । নাম তার মিজানুর রহমান মল্লিক। ৭১ সালে টাঙ্গাইল জেলার হয়ে যুদ্ধ করেছেন এই লড়াকু সৈনিক। ঘটনা শোনাতে তিনি ফিরে যান একাত্তরের সেই দিনগুলোতে। তিনি বলেন, তখন আমি মেট্রিক পরিক্ষার্থী ছিলাম। ২৫ শে মার্চের রাতে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাতে অনেক ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক সহ শত শত লোক নিহত হয়। মানুষের কান্নার আর্তনাদ, অসহায়ত্ত্ব দেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১১ নং সেক্টরের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধে নিহত এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানী হানাদারদের পরাস্ত করতে একবার ১৪ ই আগষ্টে সাটুরিয়া থানায় আমরা আক্রমণ করেছিলাম। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৫ থেকে ৬ জন নিহত হয়। শহিদ হন আমার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাও। যার কথা আমার আজও মনে পড়ে। এছাড়াও আমার বড় ভাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১০ মাস আমরা তার কোনো খোঁজ পাইনি। দেশ স্বাধীনের পর আমরা তার সন্ধান পাই।
* প্রশিক্ষণ শেষে কাঁধে নেই দুটি হাসপাতালের দায়িত্ব
যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্থ করে তুলতে অনেক ডাক্তার-নার্স ভূমিকা রেখেছেন। তার মধ্যে অঞ্জু রায় অন্যতম। ৭২ বসন্তে পা রাখা এই নারী মুক্তিযোদ্ধার জন্ম রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। ১৯৭১ সালে শরণার্থী ক্যাম্পে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেছেন । সেদিনের সেই দিনগুলো স্মরণ করতেই অশ্রুজ্বলে সিক্ত হন তিনি । স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু ও সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। তিনি বলেন, নিজ জন্মভূমি ছেড়ে ১৯৭১ সালে সম্ভবত এপ্রিলের মাঝামাঝি আমরা সপরিবারে দেশ ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমাই । আশ্রয় মেলে কল্যানীর ৬নং ক্যাম্পে। বাবা কুঞ্জ বিহারী রায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। আমরা যে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই ক্যাম্পে বাবা অসুস্থ শরণার্থী ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদান করতে থাকেন। বাবার সঙ্গে আমিও নার্সিংয়ের কাজ করতে থাকি।
তিনি আরও বলেন, একবার কলকাতা থেকে আমাদের ক্যাম্পে এক ডাক্তার আসেন। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ম্যাট্রিক পাস মেয়ে খুঁজতে থাকেন। ওই ক্যাম্পে আমিই একমাত্র মেয়ে ছিলাম যে কিনা বিজ্ঞানে ম্যাট্রিক পাস। প্রথম দিকে আমি একটু সংশয়ে থাকলেও মা-বাবা বুঝিয়ে বলেন, আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তুমি সামনে না আগালে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এ কথার পর আর বসে থাকিনি। ১৫ দিনের নার্সিং প্রশিক্ষণ শেষে কাঁধে নেই দুটি হাসপাতালের দায়িত্ব। তারপর আমার সেবার দক্ষতা দেখে আমাকে টিম লিডার করা হয় । আমার নিয়ন্ত্রণে ৭ জন স্বেচ্ছাসেবক নার্স ছিলেন। আমাদের টিম ২৪ ঘণ্টা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্থ করতে কাজ করেছে। এছাড়াও বালিয়াকান্দির সাধুখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। পরে আমাদের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন।
এসএম