Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

ঢাকার চাপ কমবে কবে?

আবু ছালেহ আতিফ

আবু ছালেহ আতিফ

এপ্রিল ৬, ২০২৩, ০২:৫১ পিএম


ঢাকার চাপ কমবে কবে?
  • সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে,
  • ঢাকা থেকে প্রস্তাবিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কমাতে হবে 
  • ঢাকার বাইরের কর্মসংস্থান গুলোতে কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে- অধ্যাপক ড.আদিল মুহাম্মদ খান
     

পাঁচ বছরের মধ্যে স্যাটেলাইট টাউনশিপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা
প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট টাউন রিং রোড এর মাধ্যমে সংযোগ হবে
প্রকল্পে আবাসনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে
কেরানীগঞ্জ ও সাভারে প্রকল্প গ্রহণের জন্য সমীক্ষা কার্যক্রম শেষ-রাজউক
 

রাজধানী ঢাকা  দিনে দিনে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। ঢাকামুখী নতুন মানুষের ভীড় এটাকে আরও নাভিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই নানানমুখী মানুষের ঠ্যাসাঠেসিতে নাজেহাল অবস্থা নগরীর প্রতিটা কোনায়। সবার অভিযোগ অতিরিক্ত মানুষের ভীড়ের সাথে নতুন মানুষের আনাগোনাই এর জন্য দায়ী। আর এ জনঘনত্বের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে  যানযট, শব্দদূষণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা, মলমূত্র ত্যাগের মত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সব মিলিয়ে সচেতন সমাজের প্রশ্ন জেগেই যায়, ঢাকাতেই কেনো এত যন্ত্রণা। অন্যদিকে ঢাকাকে বাসযোগ্য পরিবেশ হিসেবে তৈরী এখনো পর্যন্ত যত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বরং অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ছে জনঘনত্ব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, প্রতি বছর ঢাকা  শহরের জনসংখ্যায় নতুন করে যোগ হচ্ছে ৬ লক্ষাধিক মানুষ।  নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে  ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দিন মজুর থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, সরকারি বেসরকারি চাকুরিজীবী সবার পছন্দ যেনো বসবাসের অনুপযুক্ত রাজধানী ঢাকা। এত ভোগান্তির পরেও কেনো সবাই ঢাকায় আসছেন তার খোঁজে উঠে আসে কিছু বাস্তবতা। 

গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন কর্মসংস্থান কেন্দ্র, ফুটপাত, আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে এ জনঘনত্বের প্রধান কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মুলতঃ কর্মসংস্থান, গৃহহীনদের আশ্রয়, উন্নত শিক্ষা, ভালো চিকিৎসা সবকিছুর জন্য মানুষ বেছে নিচ্ছে ঢাকাকেই। সরেজমিনে দেখা যাচ্ছে, ঢাকাতে যতটা সহজে কাঁচা টাকা আয় করা সম্ভব তা গ্রামাঞ্চলে সম্ভব না। যার ফলে সাধারণ পেশার মানুষের প্রধান নজর থাকে ঢাকা।

রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, রাজধানীতে সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থানের জন্য রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ জনঘনত্বের হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত  জনঘনত্ব ৫০০ জন। এর ভিতরে আবার দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ সিটিতে মানুষের চাপ আরও বেশি।

কুড়িগ্রাম থেকে রিকশা চালাতে রমজানের প্রথম দিকে ঢাকা এসেছেন কবির (৩৪)। ঢাকা ছাড়া নির্ভর করার মত আয়ের স্থল নেই বলছেন কবির। এ রিকশা চালক বলেন, গ্রামে থেকে টুকটাক যা ইনকাম হয় তা আসলে বর্তমান বাজার হিসেবে কিছুই না। আবার গ্রামে কাজও নেই। কিন্তু ঢাকা আসলে রিকশা নিয়ে বের হলেই খরচ বাদ দিয়ে ও যা থাকে তা চলার মত।

খুলনা থেকে ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজে অনার্স দিত্বীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন আবরার হোসেন। খুলনাতেও তো পড়া যেতো ঢাকায় এত ভোগান্তি করেও কেনো পড়তে হবে? প্রশ্নের জবাবে আবরার আমার সংবাদকে বলেন, আসলে ঢাকায় ভোগান্তি হলেও বাস্তবতা শেখা যায় এখানে বেশি।  বর্তমান চাকরির বাজারের যে প্রতিযোগিতা এবং সব অফিস আদালত রাজধানীতে এসবের সাথে নিজেকে এগিয়ে রাখতে মুলত ঢাকায় থাকা।

ঢাকার জজকোর্টের এডভোকেট মো. সোহেল। তার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী। ছোটোবেলা থেকেই ঢাকায়  চাকরি করে থাকার সখ।তিনি বলেন ঢাকা যদিও সবকিছু মিলিয়ে বসবাস অনুপযোগী। তবুও পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এখানে থাকাটা আমার মত অনেকের কাছে নেশার মত হয়ে গেছে। এভাবে সব মিলিয়ে বলা চলে, সব শ্রেনী পেশার মানুষের চাপে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রাজধানী ঢাকার। এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখার কথা বলা হয়েছে। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। কিন্তু ঢাকায় জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে বসবাস করে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন। এবং ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।

ঢাকায় এত ভীড়ের রহস্যটা কি এটা সম্পর্কে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, মুলত কর্মমুখী মানুষের প্রধান লক্ষ্যই থাকে কিছু হলে ঢাকায় আসা। এটার যৌক্তিকতা ও রয়েছে বাস্তবতা অনুযায়ী। কারণ ঢাকার মত এমন কর্মসংস্থান কোথাও নেই। 

তিনি বলেন, শুধু সাধারণ মানুষ না, সরকারি, বেসরকারি, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী সবার উদ্দেশ্য থাকে ঢাকা কেন্দ্রিক বেড়ে ওঠা।মূলত এ কারনেই ঢাকা ধারন ক্ষমতার চেয়ে ১২ গুন বেশি জনসংখ্যা নিয়ে চলছে। 

ঢাকা থেকে জনসংখ্যা সরানো বা অন্য কোনো পরিকল্পনা করে বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা নিয়ে জানতে চাইলে এ (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক বলেন, জনসংখ্যা সরানো বা কোনো কর্মসংস্থান কমানো তো কঠিন ব্যপার, তবে নতুন আর কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠুক সে ব্যপারে সরকারের কঠোর থাকতে হবে। 

ঢাকায় খোলামেলা আলো বাতাসপূর্ণ জায়গার স্বল্পতা কি বাড়ানো যেতে পারে, এ সম্পর্কে আদিল খান বলেন এটাতো সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। 

আদিল খান বলেন, এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। তিনি বলেন ঢাকা যে ঢাকা যে সব যন্ত্রণা এবং  বাসযোগ্যতা হারিয়েছে তা সরকারও জানে আবার নীতি নির্ধারকরাও জানে কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপ নেই এটাই সমস্যা। 

এবং এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার তার অভাব রয়েছে। তবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যেমন সাম্প্রতিক সময়ে দুইটি বড় ইকোনোমিক জোন তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন এলাকার সাথে সংযোগস্থল তৈরির জন্য বড় বড় হাইওয়ে প্রজেক্ট তৈরি করা হয়েছে। যে দুইটি প্রকল্প দেশের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কাজ করার কথা। কিন্তু সেটাকে সাপোর্ট করতে গেলে আরও একটা বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে ঢাকার মধ্যে যেসব প্রস্তাবিত ব্যবসা প্রকল্প এবং পরিকল্পিত ব্যবসায়িক চালান কমাতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এটা কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই বরং ঢাকার সাইজ দিন দিন বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে পদ্মা সেতু হওয়ার পরে মুন্সিগঞ্জ থেকে শুরু করে পূর্বাচল, উত্তরার বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়িক ক্ষেত্র উল্টো তৈরি হচ্ছে। যার লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে না এখনো। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগই এখানে দেখা যাচ্ছে না। মোটকথা ঢাকামুখী ইনভেস্টমেন্ট কমানোর বিপরীতে আরো বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি ঢাকাতে যেসব অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম হচ্ছে সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। যেমন ফুটপাত আটকিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা হচ্ছে ,যে কেউ এসে যখন তখন এক জায়গায় বসে ব্যবসা করছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। বরং সেখানে যারা ব্যবস্থা নিবে তারাই বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে এসব ফাঁকা জায়গা দখল করে রাখছে। মোটকথা ঢাকার জনসংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে এবং নীতি নির্ধারকদের এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। যদিও ঢাকার বাইরে কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে কিন্তু সেখানে কাজের সুযোগ খুব অল্প। যেকারণে মানুষ ঢাকায় ছুটছে বলে মনে করেন এ পিআইডি পরিচালক।

এ ব্যপারে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, রাজউক ঢাকা শহরকে চাপমুক্ত করার জন্য স্যাটেলাইট টাউনশিপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এবং প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট টাউন রিং রোড এর মাধ্যমে সংযোগ হবে। শুধুমাত্র এই প্রকল্পে আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে না, আবাসনের পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য দূষণমুক্ত শিল্প, পাইকারি বাজার, ওয়ার হাউস, কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকবে। যার মাধ্যমে বিদ্যমান শহর অনেকটা  চাপমুক্ত হবে এবং মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। 

তিনি বলেন ইতোমধ্যে রাজউক কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায় প্রকল্প গ্রহণের জন্য সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।এ প্রকল্প শেষ হতে কতদিন সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, সমীক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়েছে কিন্তু পুরো প্রকল্প শেষ হতে পাঁচ বছর সময় লাগবে।

আরএস

Link copied!