জানুয়ারি ১৯, ২০২৪, ০৬:৪২ পিএম
প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে বায়ুদূষণের পরিমাণ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে দূষণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সারা বিশ্বে বায়ু দূষণে প্রায়ই প্রথম স্থানে অবস্থান করে। এতে করে আমাদের পরিবেশের যেমন বিরূপ প্রভাব ফেলছে তেমনি ক্ষতি হচ্ছে শারীরিক।
বায়ু দূষণের নানা কারণ থাকলেও, সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মানব সৃষ্ট নানা জিনিসের ফলে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে বায়ু দূষণের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু শীতকালে সেটা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
বায়ু দূষণ নিয়ে নানা মতনৈক্য থাকলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ‘পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অনিষ্টকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতি করে সেই অবস্থাকে বায়ুদূষণ বলে।’ প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু বা বাতাস।
অন্যান্য যে কোনো দূষণের চেয়ে বায়ুদূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ বাতাস স্বল্প সময়ে দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত ঝুঁকিগুলোর একটি। পুরো বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষণযুক্ত বায়ুতে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার বেশি।
বায়ুদূষণ পরিবেশগত ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত দুই ধরনের হতে পারে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে অকালে মৃত্যুর শতকরা ৮৯ ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হয়ে থাকে।
প্রধান বায়ুদূষণগুলো:
বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ক্ষতিকর গ্যাসীয় ও রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করা হয়েছে। যেমন (ক) বস্তুকণা, বস্তুকণার উপাদানগুলো হলো নাইট্রেট, সালফেট, এমোনিয়া, কালো কার্বন, এন্ডোটক্সিন এবং ধাতুগুলো যেমন- লোহা, কপার, নিকেল, জিংক ইত্যাদি। আকার অনুযায়ী বস্তুকণা ৩ ধরনের-ভারী, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র কল-কারখানা, যানবাহন ও জ্বালানি নির্গত ধোয়ায় বস্তুকণা ভাসমান থাকে।
বাংলাদেশের বায়ু মান সূচক বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ওজোন এ পাঁচ প্রকার দূষণের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। বায়ুর মান সূচকের রিপোর্ট করার জন্য শূণ্য থেকে ৫০ ভালো, ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি ভালো, ১০১ থেকে ১৫০ সাবধানতা, ১৫১ থেকে ২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ থেকে ৫০০০ তীব্র অস্বাস্থ্যকর)এই স্কেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত অছও-এর মাত্রা ২০০ অতিক্রম করলে স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বেতার, টিভিতে প্রচার করা হয়।
বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলো :
বায়ুদূষণের কারণগুলো প্রধানত মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক এ দুই ধরনের হয়ে থাকে।
(ক) মানবসৃষ্ট কারণ :
ভূঅভ্যন্তর থেকে উত্তোলিত জ্বালানি যেমন- ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন তেল ইত্যাদি পোড়ানোর ফলে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কনা বায়ুদূষণ করে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, পরিত্যক্ত বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া বায়ুদূষণের কারণ। ইটভাটা, রান্নার কাজে নির্গত ধোয়া ও কয়লা পোড়ানো, ধূমপান, টায়ার পোড়ানোয় বায়ুদূষণ ঘটে। যুদ্ধে ও পারমাণবিক চুল্লিতে দূর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ হলে বায়ুদূষণ ঘটে। কৃষিক্ষেত্রে আগাছা, কীটনাশক, জৈব ফসফেট এবং ক্লোরিনযুক্ত হাইড্রোকার্বন বায়দূষণ ঘটায়।
(খ) প্রাকৃতিক কারণ :
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ, জৈব ও অজৈব পদার্থের স্বাভাবিক পচনে সৃষ্ট গ্যাস, দাবানল ও ধূলিঝড় বায়ুকে দূষিত করে।
বায়ুদূষণে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উচ্চমাত্রার বায়ু সেবনে ফুসফুসে সংক্রমণ, হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসারজনিত রোগের আধিক্য লক্ষণীয়। বিশেষত শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী বায়ুদূষণে বেশি আক্রান্ত হন।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব শুধু মারাত্মকই নয়, সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও রয়েছে। পরিবেশগত কারণে ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণের সম্মিলিত প্রভাব প্রতি বছর ৬৭ মিলিয়ন অকাল মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। বায়ুদূষণ মানব শরীরের সব প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, কিডনি ইত্যাদিকে আক্রান্ত করে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে যা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
বায়ুদূষণ অসংক্রামক রোগগুলোর অন্যতম কারণ। শ্বাসনালি সংক্রমণের অন্যতম কারণ গৃহস্থালি সংক্রান্ত বায়ুদূষণ যা পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের নিউমোনিয়ায় মৃত্যু প্রায় ৪৪ শতাংশ। প্রসবপূর্ব বায়ুদূষণের কারণে প্রায়ই নবজাতকের নানা রোগ দেখা দেয় যার মধ্যে অকাল জন্ম, কম জন্মের ওজন এবং বিকাশগ্রস্ত ফুসফুসের ত্রুটি উল্লেখযোগ্য। বায়ুদূষণ ফুসফুসের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে যা শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের অ্যালার্জিজনিত শ্বাসযন্ত্রের রোগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসারের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ থেকে আসা কার্সিনোজেন।
মস্তিষ্কের রক্তনালির সমস্যা যাকে স্ট্রোক নামে পরিচিত ও হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির সমস্যা যা হার্ট ফেইলর ঘটায় তার প্রায় ২৩ শতাংশ ও ৩২ শতাংশ কারণ এ বায়ুদূষণ। মস্তিষ্কের নানা রোগের মধ্যে রয়েছে এলঝেইমার্স ও পারকিন্সন ডিজিজ যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি ও স্মৃতিশক্তি বিলোপ করে। এসবের প্রভাবে পরবর্তিতে স্মৃতিভ্রম দেখা দেয়।
বাংলাদেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দশকে বায়ুদূষণ মৃত্যুর জন্য একটি অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বায়ুদূষণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে এটা চীনের মতো দেশগুলোতে যেখানে দ্রুত নগরায়ণ ও গ্রামীণ থেকে শহুরে অভিবাসন ব্যাপক হারে হয়েছে সেখানে মনোরোগ দ্রুত বৃদ্ধি দ্বারা বোঝা যায়।
সূক্ষ্ম কণা যা বায়ুদূষণ ঘটায় কিছু স্বাভাবিক মানসিক সমস্যা যেমন :
হতাশা, উদ্বেগ এবং কর্মহীনতার সঙ্গে জড়িত। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব এখনো খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না বা এ ব্যাপারে আরও অধিকতর গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেসব মানসিক রোগ বায়ুদূষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তার মধ্যে রয়েছে ডিমেনশিয়া, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেশন/বিষণ্নতা ইত্যাদি। বাতাসে বেনজিন ও কার্বণ মনো অক্সাইডের উপস্থিতি সিজোফ্রেনিয়া রোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
কোরিয়ান একটি গবেষণাপত্রে বাতাসে নাইট্রিক অক্সাইডের অত্যাধিক মাত্রায় উপস্থিতি ডিপ্রেশনে/বিষণ্নতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত দেখা গেছে। সাউথ কোরিয়ার এক গবেষণায় আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও ওজোনের মাত্রার সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
বায়ুদূষণ প্রতিরোধের উপায় :
বায়ুদূষণ প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ হলো বায়ুমণ্ডলে নির্গমনের আগেই বায়ুদূষক উৎসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, জ্বালানি পরিশোধন, মোটরগাড়ি চালনায় জনসচেতনা প্রভৃতি প্রয়োগ করা যেতে পারে-
(ক) যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ : যানবাহন থেকে নির্গত বায়ুদূষক যেমন কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড প্রধান। সিএনজিচালিত যানে এ দূষণ কম হয়।
(খ) কল-কারখানার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ : এজন্য ধোঁয়া নির্গমন নল ও চিমনি থেকে বস্তুকণা পৃথক করার জন্য ছাকনি বা অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
(গ) দূষণ পদার্থ শোষণ : এ পদ্ধতিতে দূষণ পদার্থের শোষণ করা হয়।
(ঘ) বিকল্প জ্বালানি প্রয়োগ : জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ হ্রাস করে সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করা যায়।
(ঙ) পরিত্যক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : পরিত্যক্ত বর্জ্য না পুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা যায়।
(চ) কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ : কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প উপায়ে শস্যের রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
(ছ) পচনযোগ্য দ্রব্য দ্রুত অপসারণ : হাটবাজার, বসতবাড়ি থেকে পচনশীল দ্রব্য দ্রুত অপসারণ করতে হবে। ডাস্টবিনের ময়লা দ্রুত শোধনাগারে পাঠাতে হবে।
(জ) অঞ্চল ভাগ : নগরে বসতি, শিল্প-কারখানা পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করতে হবে।
(ঝ) বৃক্ষরোপণ : উদ্ভিদ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ভারসাম্য বজায় রাখে।
এইচআর