Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

জাতিসংঘের ভাষণে ড. ইউনূস

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববাসীকে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪, ১২:০৫ এএম


নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববাসীকে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হতে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস।

ভাষণে তিনি গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্বসম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের, অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশের এই ‘মুনসুন অভ্যুত্থান’ আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বগ্রহণ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, যে রাষ্ট্রকাঠামো দুঃসহ হয়ে গেছে, তার পুনর্গঠনের জন্য আমাদের তরুণরা এবং দেশের আপামর জনসাধারণ একমত হয়ে আমার এবং আমার উপদেষ্টা পরিষদের উপর আস্থা রেখে সরকার পরিচালনার এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে।

তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা গভীর বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে মুখোমুখিভাবে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের অর্থ-সম্পদকে নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল, কীভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সব ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এককথায়, কীভাবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এরকমই এক অবস্থায় দেশকে পুনর্গঠন এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের উপর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।

তিনি বলেন, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সব রাজনৈতিক দল এখন স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে।

যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার- জানান ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে- এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

তিনি বলেন, আমাদের একজন কৃষক বা শ্রমিকের সন্তানও যেন সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে, সে লক্ষ্যে বিশালাকার অবকাঠামো নির্মাণের বদলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির উপর আমরা গুরুত্বারোপ করছি। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার সব পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই আমাদের অভীষ্ট।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে সব আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পক্ষভুক্ত, সেগুলো প্রতিপালনে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক বিশ্বকাঠামোতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান অব্যাহত থাকবে।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।

দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে অন্তর্র্বতী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশের গণআন্দোলনকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান এবং এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গঠন এবং তার কাজ শুরু করার জন্য দ্রুত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, দায়িত্বভার গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা গুম প্রতিরোধে যে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাতে যোগদান করেছি। এর আশু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দেশীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বাংলাদেশে বিগত দেড় দশকে যেসব গুমের অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন এ মুহূর্তে কাজ করছে বলে জানান অধ্যাপক ইউনূস।

তিনি বলেন, মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে এবং নির্মম অতীত যেন আর ফিরে না আসে, সেজন্য আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট খাতে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সে লক্ষ্যে আমরা বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করেছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কোনো বিদেশি ব্যবসা বা বিনিয়োগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতেও আমরা বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেন, এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

ইএইচ

Link copied!