আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম
আগস্ট ২৭, ২০২১, ০৭:১৫ পিএম
কমছে করোনার প্রভাব; শুরু হচ্ছে রাজনৈতিক আমেজ। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও ১৪ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিসহ অন্যান্য সব দলেই আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। রাজনৈতিক মাঠের দিকেই দৃষ্টি সবার। করোনার কারণে রাজনৈতিক গতি নষ্ট হওয়ায় সব দলই জনপ্রিয়তা তৈরিতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করছে, নির্বাচনের এখনো প্রায় আড়াই বছর বাকি থাকলেও ৫২৯ দিন জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দূরে। এটি সরকারবিরোধীরা যে কোনোভাবে কাজে লাগাতে পারে। সে জন্য ছাত্রসংগঠনসহ সবাইকে মাঠে থাকতে দলের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দলের সব শাখার কমিটিসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে মনোযোগী হচ্ছে।
অন্যদিকে ক্ষমতার স্বাদ না পাওয়া বিএনপি ডাক দিচ্ছে আন্দোলনের। সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ৫টি বিষয়ে জোরালোভাবে আলোচনা হয়েছে। আগামী দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে ২০ দলীয় জোটকে চাঙ্গা, জামায়াতের সাথে দূরত্ব কমিয়ে অতীতের ন্যায় কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা, আগামী নির্বাচনে দল জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন— তা আগে থেকেই ঠিক রাখা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা আগেই পৌঁছে দেয়া এবং ভবিষ্যৎমুখী রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ঠিক করা।
শুধু দেশের জনপ্রিয় দুটি দলই নয়, বামপন্থি দলগুলোও নির্বাচনি হিসাব বুঝে নিতে মাঠে তৎপর হয়ে উঠেছে। ‘ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলুন’ স্লোগানে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গণসংহতি আন্দোলনের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে সরকার হটানোর ঘোষণা দেয়া হয়।
এ ছাড়া ড. কামালকে সামনে রেখে আবারও নির্বাচনি জোট করার চেষ্টা হচ্ছে বড় একটি অংশের। তবে রাজনৈতিক বিচক্ষণ ব্যক্তিরা বলছেন, সব দলেরই এখন কাজ হবে রাজপথেই ঐক্য তৈরি করা। জনগণের ভাষা বুঝে কর্মসূচি দেয়া।
বিএনপির দুই নীতিনির্ধারণী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করেই তারা রাজপথে নামার চিন্তা করছেন। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে একাদশ সংসদ নির্বাচনে গিয়ে তাদের যত ভুল হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণে আনা হয়েছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি যদি ক্ষমতা যেতো, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হতেন— জানতে চাইলে বিএনপি তখন স্পষ্ট করতে পারেনি। তবে এবার সেটি আগেই স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়া নির্দেশ দিয়েছেন। দল হারুক কিংবা জিতুক, তারেক রহমানই হবেন প্রধানমন্ত্রী— এমন একটি ঘোষণা দিতে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। জনগণের চাহিদা ও ভবিষ্যৎমুখী রেখে কী কাজ করবে, তা আগে থেকেই ছক আকারে দাঁড় করানো হবে, জনগণকে জানানো হবে। বিএনপি এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সংগঠনকে গোছানোর দিকে। মহানগর কমিটির পর বিএনপি এখন দেশে যেসব জেলায় কমিটিগুলো অকার্যকর, সেগুলোতে নতুন কমিটি নিয়ে কাজ করছে। অক্টোবরের মধ্যে বিএনপি সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে কাজ করবে। ইতোমধ্যে মহানগরীর দুই আহ্বায়ক কমিটি গঠনে ‘শোডাউন’ করার কথা বলা হয়েছে। ইতিপূর্বে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়ান দলটির নেতাকর্মীরা। এরপর পুলিশ শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে। অন্তত ৩০ জনকে গ্রেপ্তারও করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি— এসব ইস্যু যখন ঘটবে, তখনই কর্মসূচির মাধ্যমে কমিটিগুলোকে সক্রিয় থাকতে হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে।
আ.লীগ সূত্রমতে, চলতি ও আগামী বছরকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এ সময়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করার জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন শেষ করতে চায় দলটি। এজন্য আগামী সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করবেন আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা। যদিও দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ও পরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বেশকিছু স্থানে সম্মেলনও শেষ করেছিল দলটি। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি সংক্রমণ রোধে দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ রয়েছে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম। বন্ধ রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সাংগঠনিক সফরও। তবে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমছে। ফলে আগামী মাস থেকে ব্যাপকভাবে কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুধু তৃণমূলে সম্মেলন নয়, তৃণমূলে সৃষ্ট দলীয় কোন্দল নিরসনেও জোর দেয়া হচ্ছে। কেন্দ্রে জমা পড়া তৃণমূলের অভিযোগ, স্থানীয় এমপি ও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বলয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তৃণমূলের ত্যাগীরা। কোন্দল ও দ্বন্দ্বের কারণে অভিমানে দূরে সরে যাচ্ছেন তারা। সংসদ সদস্যরা বলয়ভিত্তিক রাজনীতি ধরে রাখতে বিএনপি-জামায়াতসহ ভিন্নপন্থিদের দেদার দলে প্রবেশ করাচ্ছেন। তৃণমূলের এমন অভিযোগও গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আওয়ামী লীগ। একই সাথে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন না দেয়ার জন্য দলীয় সভানেত্রীর কাছে বিশেষ সুপারিশ করা হবে বলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সূত্রে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আমার সংবাদকে বলেন, ২১ আগস্টের পরপরই আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের প্রস্তুতি শুরু করেছি। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এ কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করবো। তিনি আরও বলেন, অনেক স্থানে কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হবে এবং নতুন ও যোগ্য নেতৃত্ব তুলে আনা হবে। একই সাথে যেসব স্থানে দলের মাঝে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিভক্তি, বিভাজন ও বলয়ভিত্তিক রাজনীতির সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো ভেঙে দিয়ে তৃণমূলকে আরও শক্তিশালী করা। মাঠের রাজনীতির এসব সাংগঠনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক আমার সংবাদকে বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগে চারটি জেলার সম্মেলন বাকি আছে। এ চারটি জেলার প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলাসহ প্রতিটির সম্মেলনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার দায়িত্বশীল নেতারা কাজ শুরু করেছেন। অনেক ইউনিয়ন সম্মেলন শেষ করেছে। আশা করি অক্টোবরের মধ্যেই এ চারটি জেলার সম্মেলন শেষ করবো এবং নতুন নেতৃত্ব তুলে আনবো। বিএনপি জ্বালাও- পোড়াও এবং আগুন সন্ত্রাসের রাজনীতিতে ফিরতে চায় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সরকার হটানোর জন্য যে কোনো বিরোধী দল হুঙ্কার দেবে, আন্দোলন-সংগ্রাম করবে, মিছিল-মিটিং করবে; কিন্তু তা হতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও করে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। জোর করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া যাবে না। রাজনীতির নামে আগুন-সন্ত্রাসের অপরাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য বিএনপিকে পুনর্গঠন করে শক্তিশালী করা হচ্ছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে জনগণের একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করতে আমরা দাবি জানাচ্ছি। ঐক্যে পৌঁছাতে আমরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকারকে হটানোর আন্দোলনের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশকে যদি আমরা মুক্ত করতে না পারি, আওয়ামী লীগকে যদি সরাতে না পারি, তাহলে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবো না, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও মুক্ত করতে পারবো না। আমরা হাজার হাজার মানুষ যেসব মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আছি, আমরাও মুক্ত হতে পারবো না। সে জন্য আমি আগাম আন্দোলনের প্রস্তুতির আহ্বান জানাচ্ছি। ফখরুল বলেন, আমাদের রাস্তায় নামতে হবে, সোচ্চার হতে হবে এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ সরকারকে পরাজিত করতে হবে। তাদের বাধ্য করতে হবে যে, নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে।
বিশিষ্ট আইনজীবী গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার দল গণফোরাম রাজনীতিতে কার্যকরভাবে কিছু করতে পারে— সে চেষ্টা তো আছেই। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেটা আছে, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। এর চেয়ে বেটার রাজনৈতিক মোর্চা বা প্ল্যাটফর্ম কিছু যদি করা যায়, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। তবে ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে আমরা আগে কাজ করেছি, সেই চিন্তাগুলো এখনো আছে।’
আমারসংবাদ/জেআই