আগস্ট ২৮, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম
ই-কমার্স নামটি একসময় মানুষের কাছে অপরিচিত একটি শব্দ এবং হাসির বিষয় হলেও বর্তমানে এই সেক্টরের সাথে জড়িয়ে আছে কয়েক লাখ উদ্যোক্তার পরিবারের জীবন। বাংলাদেশে ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্যেও গতি পেতে থাকে মূলত ২০১৩ সালের দিকে। সে বছর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সময়ে দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট (থ্রিজি) সেবা চালু করার মধ্য দিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখে বাংলাদেশ। ই-কমার্সের শুরু থেকে সবচেয়ে কঠিন কাজটি ছিলো মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা। যে বাঙালি ১০টা দোকান ঘুরে শতশত পণ্য দেখার পরও পণ্য না কিনে বাড়িতে ফিরে আসে, সে বাঙালি অনলাইনে একটি পণ্য শুধু মোবাইলে বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্রয় করবে তা কল্পনা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তবে অবস্থা ধীরে ধীরে বদলে গেছে। বেশ কিছু পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ বহন করে। বেসরকারি এক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক দুই হাজার ৫০০টি ই-কমার্স সাইট রয়েছে। সেই সাথে ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় দেড় লাখের বেশি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা মূলত অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে। এসব প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন লক্ষাধিক পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যা বেড়ে দুই হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলার হবে। আর আগামী ২০২৩ সালে বাজারের আকার হবে তিন হাজার ৭৭ মিলিয়ন ডলারের। এমন একটি সম্ভাবনাময় খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ই-ক্যাব ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছেন গ্রাহকরা।
তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেছে কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি। এই তালিকায় আছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা, ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজুর রহমান, জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান রহমান খানের মতো নামিদামি তারকা। তাদের ‘তারকা খ্যাতি’ কাজে লাগিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপনে মানুষকে প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করার অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানির বিরুদ্ধে। এ কারণে সম্ভাবনার এই খাতে শুধু গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এর জন্য বিব্রত হচ্ছেন তারকারাও। সামপ্রতিক সময়ে ইভ্যালি, আলেশা মার্টসহ ১২টি ই-কমার্স কোম্পানির কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠায় দেশের কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্ডে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে লেনদেন স্থগিত করেছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— ধামাকা, আদিয়ান মার্ট, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, কিউডটকম, বুমবুম, আদেন মার্ট, নিডস, দালাল প্লাস ও বাজাজ কালেকশন। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বর্তমান সময়ে যে কয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তার বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের সাথেই রয়েছে তারকাদের সম্পর্ক। কেউ এর গ্রাহক হিসেবে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, আবার কেউ সরাসরি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করেছেন। সব চেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা ইভ্যালির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান রহমান খানকে গত ১০ মার্চ শুভেচ্ছা দূত হিসেবে যুক্ত করে ইভ্যালি। দুই বছরের জন্য তিনি ‘ফেস অব ইভ্যালি’ হিসেবে কাজ করবেন বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
বেশ কয়েকজন গ্রাহক আমার সংবাদের কাছে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন। ই-অরেঞ্জ থেকে গত জুন মাসে বাইক এবং হোম থিয়েটার দুই লাখ ২৩ হাজার টাকা পরিশোধ করে অর্ডার করেছিলেন ক্রেতা জামান। ২০ কর্মদিবসের মধ্যে তা ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো পণ্যই হাতে পাননি। প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সমাধান মেলেনি। ধামাকাশপিংয়ে গত মার্চ মাসে এক লাখ ৩০ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করেছেন রাজধানীর আরাফাত। পাঁচ মাস চলে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো পণ্যই হাতে আসেনি। বারবার অফিসের নম্বরে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান পাননি। ধামাকায় বিনিয়োগ করা ইউনিক ওয়াচ এবং সুন্দর লুঙ্গির মালিক মোহাম্মদ সবুজ জানান, ছয় মাস যাবৎ কোনো বিল পাইনি। ধামাকার কাছে আমি এখন পর্যন্ত ৪২ লাখ টাকা পাবো। প্রতিষ্ঠানের মালিক চিশতি সাহেব বারবার তারিখ দিচ্ছেন, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। সর্বশেষ চলতি ২৩ আগস্ট বিনিয়োগের ১০ শতাংশ দেয়ার কথা থাকলেও এক টাকাও দেয়নি তারা।
এদিকে গত কয়েকদিন যাবৎ গুলশান এবং প্রেস ক্লাব এলাকায় নিয়মিত আন্দোলন করে যাচ্ছেন আরেকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার বিজ্ঞাপনের উপর আস্থা রেখে পণ্যের অর্ডার দিয়ে ফাঁদে পড়েছেন ই-অরেঞ্জের হাজারো গ্রাহক। গত ১০ আগস্ট আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেডের কার্ডের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তাদের প্রিভিলেজ কার্ডকে নতুন মাত্রায় নিতে সহায়তা করবেন সাকিব আল হাসান। জনপ্রিয় বাঁহাতি কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান। ধামাকা শপিং থেকে সমপ্রতি নিজের পছন্দের হোন্ডা রেপসল মডেলের বাইক কিনেছেন তিনি। ভবিষ্যতেও ধামাকা থেকে কেনাকাটা অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন মোস্তাফিজ।
ই-কমার্স খাতটি যখন মানুষের বিশ্বাস অর্জন শুরু করলো তখন বাংলাদেশে ইভ্যালি নামক একটি প্রতিষ্ঠান লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে নতুন আরেকটি সম্ভাবনা দেখালো। প্রতি পণ্যে ৩০-৬০ শতাংশ ছাড় আবার কোনো কোনো পণ্যে ১০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক অফার দিয়ে মানুষকে পণ্য দিতে শুরু করলো তখন থেকে অনেকেই এ বিষয়টিকে এক ধরনের প্রতারণা বললেও সে সময় পাত্তা দেয়নি সরকার বা ই-ক্যাব। অনেকের অভিযোগ, এ বিষয়গুলো একটা সময় ই-কমার্স খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে তা জানা ছিলো ই-ক্যাবের। অদৃশ্য কোনো এক কারণে তারা তখন কোনো কথা বলেনি। বর্তমানে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়েও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই সংগঠনটির। শুধু সদস্যপদ বাতিল ও স্থগিত করেই তারা তাদের দায় এড়াচ্ছে। ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানালেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একের পর এক চিঠি/ নোটিস দিয়ে এবং দফায় দফায় বৈঠক করে নানাভাবেই এই প্রক্রিয়াকে বিলম্ব করা হচ্ছে বলে মনে করছেন এই খাতে বিনিয়োগ করা ক্ষতিগ্রস্তরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-ক্যাবের জিএম শোভন জাহাঙ্গীর আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা শুধু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্তক করতে পারি এবং তাদের সদস্যপদ বাতিল করতে পারি। কিন্তু সদস্যপদ বাতিল করলেই তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় না, তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলেই আমরা এর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারি’।
ইভ্যালির পলিসি লক্ষ করেই মূলত দেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলো ধামাকা শপিং ও ই-অরেঞ্জ। ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর পর থেকেই গা ডাকা দেন ধামাকার এমডি চিশতি। চিকিৎসার কথা বলে দেশ ছেড়ে বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছেন। কোনো প্রকার যোগযোগও রক্ষা করছেন না গ্রাহকদের সাথে। এদিকে পালাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে বর্তমানে রিমান্ডে আছেন ই-অরেঞ্জের মালিক। গ্রাহকের ভয়ে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে ইভ্যালি, ধামাকাশপিং, ই-অরেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যার কারণে এই খাতে বিনিয়োগ করা উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি অনিশ্চিয়তায় ভুগছে কয়েক লাখ গ্রাহক। এর সুষ্ঠু সমাধানের আশায় বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছেন গ্রাহকরা। ই-কমার্সে ভোক্তার আস্থা সবচেয়ে বড় শর্ত। কিন্তু এমন অঘটন ঘটলে মানুষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারাবে যা এই শিল্পকে ভয়াবহ সংকটের মুখে ফেলবে।
গত কয়েক বছরে ই-কমার্স খাতটি যেভাবে বড় হচ্ছে, যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, এখনি যদি এটাকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে এ খাতটি যে সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে তা অচিরেই অন্ধকারে রূপ নেবে। উন্নত যেসব দেশে ই-কমার্স বিকাশ লাভ করেছে, সেখানেই শক্তিশালী আইনি কাঠামো রয়েছে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প শিক্ষিত মানুষের দেশে শুধু ভোক্তা সচেতন করে ই-কমার্সের প্রতারণা রোধ করা যাবে না। এ জন্য চাই শক্তিশালী আইনি কাঠামো ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ।
আমারসংবাদ/জেআই