Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪,

অপরাধের ঢাল যখন প্রযুক্তি

নুর মোহাম্মদ মিঠু

অক্টোবর ৮, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


অপরাধের ঢাল যখন প্রযুক্তি

প্রযুক্তির অপব্যবহারেই বাড়ছে অপরাধ। বহুমাত্রিক এসব অপরাধের কারণে বেড়েই চলেছে সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা। নিরাপত্তাহীনতাও বেড়েই চলেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ২০১৯ সালে বিটিআরসি ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স সুবিধা’ নিশ্চিতে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্দেশনা জারি করলেও তা আদৌ কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে।

এরমধ্যে গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপকতা বেড়ে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনায় যাচ্ছেন না নীতিনির্ধারকরা। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কিছুদিন ঘন ঘন অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় উঠে আসছে, প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকেই উদ্ভব হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের। বরগুনার রিফাত হত্যা, রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলছাত্রী আনুশকা হত্যা, ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি কিশোরী গ্যাংর্যাপের মতো ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোন পথে যাচ্ছে তরুণসমাজ।

অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা তৈরির সময় এসেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদে রাখতে আইন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে।

এ ছাড়াও বর্তমান সময়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশ ও দেশের ছবাইরে থেকে তুচ্ছ বিষয়েই ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিংবা রাষ্ট্রেরও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে গুজব-প্রতারণা ছড়ানোর প্রবণতা। শুধু তাই নয়— হাল আমলে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে ই-কমার্সের নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা। ই-কমার্স প্রতারণায় ইতোমধ্যে অসংখ্য গ্রাহক নিঃস্বও হয়ে গেছেন।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিয়ে ও যৌতুক ঠেকাতে সরকার যেভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, অপরাধ, গুজব ও প্রতারণা ঠেকাতে কিংবা প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে এমনই সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে এনজিওর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপেও এসব উদ্যোগ নেয়া অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অভিভাবকদের সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই।

অনুসন্ধান বলছে, প্রতিটি আবিষ্কারের ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। বর্তমানে তরুণসমাজ সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। কিন্তু এর অপব্যবহারের কারণে দ্রুত ধ্বংসের পথেও এগিয়ে যাচ্ছে তারা। করোনাকালে কিশোরদের অপরাধপ্রবণতাসহ গ্যাং কালচারের আসক্তি বেড়েছে। লকডাউনে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের অপরাধের ধরনও অনেকটা বদলেছে। এ সময় অপরাধের সাথে নতুন মাত্রা দিয়েছে প্রযুক্তি।

একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম ও স্কাইপিতে নামে-বেনামে ভুয়া আইডি খুলেও অপকর্ম চলছে। আইন করাসহ এ ধরনের নানা সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ইউনিট সার্বক্ষণিক কাজ করলেও এসব চক্রকে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সচিবরাও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারিত ও ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি গুজব, ষড়যন্ত্রসহ চরিত্র হননের কাজে ব্যবহার  হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশপ্রধান।

সমপ্রতি প্রতারণা ও গুজব ছড়ানোর দায়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানসহ অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গুজব ও অসত্য সংবাদ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
 
গত কয়েক মাস ধরে দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতারণা ও গুজব। ইতোমধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-কমার্সের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টানা অভিযান চললেও প্রতারণা ও গুজব প্রচার থেমে নেই।

পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-আইসিটি বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে-এনটিএমসি সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিন শত শত অভিযোগ জমা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর ইস্কাটনে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও অনলাইনে কোরবানির গরু কিনতে অগ্রিম টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলা গুজবের মধ্যে— প্রশ্ন ফাঁস, গণমাধ্যম নিয়ে মিথ্যাচার, পুঁজিবাজার, চলচ্চিত্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অসুস্থতা, বিয়ে ও মৃত্যু, ধর্মীয় উস্কানি, মসজিদ-মন্দির ভাঙা বা হামলা, ফেসবুকে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক করে অশ্লীলতা প্রচারসহ নানা বিষয়ে মিথ্যা ও ভুয়া পোস্ট দিয়ে গুজব ছড়ানোর সংখ্যা সব থেকে বেশি। এর বাইরে নিষিদ্ধ উগ্র ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোও গুজব প্রচারণার কাজে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেছে।

অন্যদিকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণার মধ্যে— ফেসবুক, ইউটিউব বা অনলাইন পোর্টালে ই-কমার্সের নামে লোভনীয় অফারের ফাঁদ পেতে মাঠে সক্রিয় বহু চক্র, এসব চক্র লোভনীয় অফারে অর্থ হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ, বিট-কয়েনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্ড ব্যবহার করে লেনদেনের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ করছে।

বিদেশে নেয়া, বিশেষ দামি গিফট বা পুরস্কার পাঠানো, জিনের বাদশাসহ আরও বহুভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস-সিসিএ ফাউন্ডেশনের ‘সাইবার ক্রাইম ট্রেন্ড ইন বাংলাদেশ-২০২০’ শীর্ষক বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বিটিআরসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার জন। অন্যদিকে নেপলেওনক্যাট অনুযায়ী মার্চ পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো তিন কোটি ৭৯ লাখ ১২ হাজার। সম্প্রতি অ্যাপসভিত্তিক অবৈধ সুদের ব্যবসা পরিচালনাকারীও অনলাইন প্রতারক চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি।
 
গত মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের অভিযোগে নুসরাত শাহরিন রাকা নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। রাকা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও বাংলাদেশ নিয়ে গুজব প্রচারকারী একুশে টিভির সাবেক উপস্থাপক ড. কনক সরওয়ারের বোন।

একই দিন প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ই-কমার্সভিত্তিক অনলাইন টিকেটিং এজেন্সি টোয়েন্টিফোর টিকেটি ডটকম লিমিটেডের পরিচালককে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এ ছাড়া ভিডিওচিত্র ধারণ করে চাঁদা দাবি ও অনলাইনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্ল্যাক মেইলের অভিযোগে রংপুরে দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।

সমপ্রতি পঙ্গু হাসপাতালে পা কাটা রোগীদের বিনামূল্যে পা লাগানো হবে এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তারা প্রজ্ঞাপন দিয়ে বিষয়টিকে গুজব দাবি করে সবাইকে সতর্ক হতে বলেন। সর্বশেষ গতকাল ই-কমার্স প্রতারণায় কিওকমের হেড অব সেলস আরজে নীরবকেও আটক করার পর একদিনের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

গত ৫ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুজব, ষড়যন্ত্র, মিথ্যা, কুৎসা ও চরিত্র হননের কাজে ব্যবহার হচ্ছে।’ এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন তিনি।

৬ সেপ্টেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ইউটিউব, ফেসবুকের কন্টেন্ট সরানোর বিষয়ে বিটিআরসির সক্ষমতা তুলে ধরেন। ৮ সেপ্টেম্বর অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রচার রোধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে ‘আসল চিনি’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছে সরকার।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি-ডিএসএ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের-বিসিসি এলআইসিটি প্রকল্পের যৌথভাবে তিন মাসব্যাপী এ ক্যাম্পেইনে দেশের প্রায় ৭০ লাখ মানুষকে সচেতন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার রোধে এক লাখ অনলাইন অ্যাকটিভিস্টের সমন্বয়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরির কাজ করার কথা জানায় আওয়ামী লীগ। ৩০ সেপ্টেম্বর গুজব ও অসত্য সংবাদ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘প্রতারক ও গুজব রটনাকারীরা সবসময় নতুন নতুন মাধ্যম ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজ সচেতন হলে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণা ও গুজব রোধ করা সম্ভব হবে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের প্রতারক ও গুজব প্রচারকারী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। সমপ্রতি ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ ই-কমার্স প্রতারক চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও যারা প্রতারণা শুরু করেছে তারাও নজরদারির মধ্যে রয়েছে। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’