Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪,

তবুও এমপিদের জয়জয়কার!

রফিকুল ইসলাম

অক্টোবর ২৩, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


তবুও এমপিদের জয়জয়কার!

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মো. হেদায়েতুল আলম। তৃতীয় ধাপে এই ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নৌকার মনোনয়ন পাওয়া মো. হেদায়েতুল আলমের বিরুদ্ধে মাদক সেবন, মাদক বিক্রি, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বলে দাবি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। 

জানা যায়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সলঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন। ওই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন মো. হেদায়েতুল আলম। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন, মাদক বিক্রি, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি, সিরাজগঞ্জ রোড গোলচত্বরের নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, চেইন মাস্টার নিয়োগ ও দোকানপাট বসিয়ে টাকা আদায়, মৎস্য আড়তের নিয়ন্ত্রণ, অন্যের জায়গা দখলসহ নানামুখী অভিযোগের কারণে আলমের প্রার্থিতা বাতিল করে দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।

বিতর্কিত আলম নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ দলটির স্থানীয় নেতাকর্মী ও মনোনয়ন বঞ্চিতরা।ইতোমধ্যে তারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে তার প্রার্থিতা বাতিলের জন্য অভিযোগও করেছেন। 

অভিযোগ করতে আসা হাটিকুমরুল ইউনিয়ন আওযামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, দলের নেতাকর্মীরা বর্তমান চেয়ারম্যানের ওপর ক্ষিপ্ত। তার সকল কার্যক্রম দল ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আমাদের সকলের বিশ্বাস ছিলো দল তাকে এবার আর মনোনয়ন দেবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের সংসদ সদস্য তাকে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার জন্য সকল চেষ্টা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত পাইয়ে দিয়েছেন। যদিও নিজের বিরুদ্ধে উঠা ওইসব অভিযোগ মানতে নারাজ চেয়ারম্যান হেদায়েতুল আলম। 

তিনি আমার সংবাদকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সামাজিকভাবে আমাকে হেনস্তা করার জন্য এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, আমি সলঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। তাই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলাম। মাগুরার শালিখা উপজেলার ধনেশ্বরগাতী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শ্রী বিমলেন্দু শিকদার। তিনি স্থানীয় এমপির আপন ছোট ভাই।

সূত্রে জানা যায়, নিজ ভাইয়ের নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত করতে সরাসরি পক্ষপাতিত্ব করেছেন স্থানীয় এমপি। শুধু ভাই নয়, তালখড়ি, আড়পাড়া, শতখালী, শালিখা ও বুনাগাতী ইউনিয়নে নিজ বলয়ের লোককে নৌকা পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। ফলে মনোনয়ন-বঞ্চিত হয়েছেন দলের দুর্দিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিতরা। এমপির এমন পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলো স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে অভিযোগও করেছিলেন। সভানেত্রীর কার্যালয়ে আসা অভিযোগ থেকে এমনটাই জানা যায়। 

ধনেশ্বরগাতী ইউনিয়নে মনোনয়নপ্রত্যাশী এনামুল হক প্রিন্স আমার সংবাদকে বলেন, অনেক যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, সে কোনো দিন জয় বাংলা বলেনি, শুধু ভাইয়ের (স্থানীয় সাংসদ) ক্ষমতায় মনোনয়ন পেয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। এতে তৃণমূলের চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয়নি। 

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রারকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সিরাজ মণ্ডল। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সমপ্রতি দৌলতপুর থানা পুলিশের অভিযানে তার গাড়ি থেকে ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়। সে সময় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বিতর্কিত চেয়ারম্যান দ্বিতীয় মেয়াদে মনোনয়ন পাওয়ায় বেশ ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 

তারা বলছেন, নানামুখী অনিয়মের সাথে যুক্ত ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। অনিয়ম, দুর্নীতি, সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎসহ দলীয় নেতাকর্মীদের বিস্তর অভিযোগের পরও একই উপজেলার চিলমারি ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দ আহম্মেদ। অভিযোগ রয়েছে, এই দুই চেয়ারম্যানই স্থানীয় এমপির আস্থাভাজন। নিজ বলয় ভারী করতেই তাদের মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছেন। ঝিনাইদহ কালিগঞ্জ উপজেলার কাষ্টভাংগা ইউনিয়নের মনোনয়ন পেয়েছেন মো. আয়ুব হোসেন খান। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তার কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নাখোশ স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। ফলে আসন্ন তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ব্যাপক কোন্দল সৃষ্টি হবে। শুধু এই সকল ইউনিয়ন নয়, মনোনয়ন পাওয়া অধিকাংশ বর্তমান চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে ছোট বড় অনেক অভিযোগ রয়েছে। তাদের গত পাঁচ বছরের কার্যক্রমে খুশি নন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 

এদিকে ফেনীর পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নে জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন না দিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছে ইউনিয়নের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। গতকাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ মানববন্ধনে ইউনিয়নের শতাধিক নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আলী আকবর ভুইয়া, উপজেলা ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবুল হাসেম চৌধুরী, জেলা যুবলীগের সদস্য ফখরুল ইসলাম ফারুক, ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান চৌধুরী, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবু ইউসুফ, সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল আলম বক্তৃতা করেন। 

আবুল হাসেম চৌধুরী বক্তৃতায় বলেন, বর্তমান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ২০০৩ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ‘সরকারি দলে’ প্রবেশ করেন। এরপর জেলা-উপজেলার কিছু নেতাকে হাত করে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই ‘আওয়ামী লীগ’ নিধনে নামেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালান। মূলত অধিকাংশ স্থানে বর্তমান চেয়ারম্যানরা বহাল থাকায় মানববন্ধন করেন তারা। 

তথ্য মতে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতোই নিজ নিজ বলয়ের নেতাদের নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত করতে তৎপর স্থানীয় সাংসদ ও দলটির প্রভাবশালী নেতারা। এজন্য তারা দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

স্থানীয় সাংসদদের এমন অবস্থানে দ্বন্দ্ব বাড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে। আর মনোনয়ন-বঞ্চিত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন দলটির ত্যাগী, পরীক্ষিত, মেধাবী ও জনপ্রিয় নেতারা। মনোনয়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ স্থানেই বহাল রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরা। যাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অনিয়ম ও নানামুখী দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

 তারাও মনোনয়নে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বিতর্কিত চেয়ারম্যানরা ফের মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরা। ফলে বিএনপি বিহীন নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। 

মনোনয়ন-বঞ্চিত হয়ে কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন। আবার অনেকেই অভিমানে দূরে সরে যাচ্ছেন। অথচ বিতর্কিদের নাম না পাঠাতে এবং স্থানীয় সাংসদদের সরাসরি পক্ষপাতিত্ব করতে নিষেধ করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। বিতর্কিতদের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, মনোনয়ন প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে প্রার্থী পরিবর্তন করা হবে।

 জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, মনোনয়ন বোর্ড যোগ্যদের মনোনয়ন দিচ্ছেন। যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তা সঠিক যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করার পর অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রার্থী পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।