রফিকুল ইসলাম
মার্চ ১৪, ২০২২, ০৬:১০ পিএম
পানির অপর নাম জীবন। রাজধানীজুড়ে জীবনঘনিষ্ঠ সেই পানি নিয়েই চলছে রমরমা বাণিজ্য। প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পানি ব্যবসা। যার কারণে বড় বোতল (জার) করে সরবরাহ করা পানির মূল্য ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটারে নেয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন দুই টাকা। অথচ ওই পানির মূল্যে চার পয়সারও কম।
অপরদিকে, প্রায় সাতগুণ বেশি মূল্যে ক্রয় করা পানি নিরাপদ নয়। বড় বোতলে সরবরাহ করা পানি কেবল নামেই পরিশুদ্ধ ভোক্তা পর্যায়ে রয়েছে এমন সীমাহীন অভিযোগ।
অর্থাৎ উচ্চমূল্যে কেনা হচ্ছে উচ্চ ঝুঁকি। সরাসরি ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে শুধু ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে তা বোতলে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে বলে নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এ চিত্র শুধু রাজধানীর নয়, বরং দেশের সব মহানগরী ও জেলা শহরের চিত্র এক এবং অভিন্ন। বিত্তবানরা অধিক মূল্যে বোতলজাত পানি ক্রয় করে পান করলেও সাধারণ মানুষ অনিরাপদ পানি পান করছে। ফলে কোটি কোটি মানুষ পানিবাহিত নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তারা ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস ও লিভারের নানা জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সূত্রে মতে, রাজধানীর আবাসিক এলাকায় ওয়াসার এক হাজার লিটার পানি মূল্য ১৭ টাকা ও বাণিজ্যিক পানির মূল্য ৩৫ টাকা মাত্র। অথচ বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত যে সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জারের মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করে, তারা পানিভর্তি একটি জারের মূল্যে রাখে ৪০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত।
অর্থাৎ সর্বনিম্ন ৪০ টাকা হিসাবে প্রতি লিটার পানির দাম নেয়া হচ্ছে দুই টাকা। অথচ ওয়াসার হিসাবে প্রতি লিটার পানির মূল্য চার পয়সারও কম। জারের মাধ্যমে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন অফিস, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে সাপ্লাই দেয়া এসব পানি আদৌ পরিশোধন করা হয় কি-না তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা নেই কারো কাছে।
অভিযোগ রয়েছে, জারে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা অধিকাংশ পানিই সরাসরি ওয়াসার সাপ্লাই করা। যা শুধু ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে তা জারে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। জারের এসব পানি ব্যবসা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন দলের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা। বসে নেই স্থানীয় কাউন্সিলর ও তাদের নিজ নিজ সিন্ডিকেটের কর্মীবাহিনী। নিয়ম করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা তুলছেন। কেউ কেউ আবার রাজনীতির পাশাপশি এ ব্যবসার সাথে সরাসরি যুক্ত।
যদিও জারে বাণিজ্যিকভাবে পানি ব্যবসার সাথে জড়িতদের অভিযোগ, প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদার পাশাপাশি তাদের বাসাবাড়িতে জারের পানিও সরবরাহ করতে হয়। প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদাবাজির কারণে সঠিক দামে জারের পানি বিক্রি করতে পারছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
তাদের দাবি, জারের পানি নির্ধারিত দামে বিক্রি সম্ভব হবে, সে ক্ষেত্রে চাঁদার সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে। নইলে কোনোভাবেই নির্ধারিত দামে পানি বিক্রি সম্ভব নয়। শুধু চাঁদাবাজির কারণে অনেকেই পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি ওয়াসার পানি দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন। যা থেকে প্রতিদিন নানামুখী স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। রাজধানীর মগবাজার এলাকার ব্যবসায়ী আবু বক্কার সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘জারের বোতলজাত পানির চাহিদা আগের থেকে কমেছে।
তবে এখনো অনেক বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ এক লিটার পানি কত টাকায় বিক্রি করা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটি জারে ১৯ লিটার পানি ধারণক্ষমতা রয়েছে। জারের এক বোতল পানি বিক্রি করা হয় ৩০ থেকে ৬০ টাকা পর্যান্ত। ৩০ টাকা থেকে শুরু, দূরত্ব বুঝে দাম নেয়া হয়।’ গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজার লিটারের বেশি পানি বিক্রি করেন তিনি।
পল্টন এলাকায় অবস্থিত জারের পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান উইনার ফ্রেশ ড্রিংকিং ওয়াটারের কর্মচারী সালাউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক, বিমা ও অফিসগুলোতে আমরা পানি সরবরাহ করি। প্রতিটি জারের মূল্যে রাখা হয় ৭০ টাকা। আমাদের পানিতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের পানি একেবারে ফ্রেশ। যারা এর থেকে কম টাকায় একটি জার বিক্রি করেন তাদের পানিতে সমস্যা আছে।’
জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকার চা-বিক্রেতা ফিরোজ বলেন, ‘পানি কোথা থেকে আসে, আমি সঠিক জানি না। তবে যতটুকু জানি পানি ভালো এবং পানি নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০ লিটারের জার আমরা ৬০ টাকায় নিয়েছি। এক গ্লাস পানি বিক্রি করি এক টাকা। একটি জার থেকে ৯০ থেকে ৯৫ গ্লাস পানি হয়।’
মতিঝিল এলাকার চা-বিক্রেতা আল আমিন বলেন, ‘জার প্রতি এতদিন ৩০ টাকা দিয়ে এসেছি। যাদের থেকে প্রতিদিন পানির জার নেয়া হয়, তারা দাম বাড়াবে বলে জানিয়েছে। হয়তো অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আবার দাম বৃদ্ধি করা হবে।’ তবে এই জারের পানি কোথা থেকে আসে এবং বিশুদ্ধ কি-না তা সঠিক জানেন না এ চা-বিক্রেতা।
গুলিস্থানের চা-বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কোথা থেকে পানি আসতাছে, তা দেখার ইচ্ছে বা আগ্রহ নেই। নগদ টাকা দেই, পানি লই। সাধারণ মানুষের কাছে দুই টাকা গ্লাস বিক্রি করি। এটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুরের এক পানি ব্যবসায়ী বলেন, ‘পানির ব্যবসা সিন্ডিকেট যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রতিদিন তাদের নির্দিষ্ট কমিশন দিতে হয়। নইলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।’
খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় বসবাসরত মানুষের প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী খাবার পানি সরবরাহ করতে পারছে না ওয়াসা। অনেক এলাকায় ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি দুর্গন্ধ। ওই দুর্গন্ধযুক্ত পানি ফুটিয়েও পান করা যায় না। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হওয়া জারের পানি সংগ্রহ করছেন নগরে বসবাসরত নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ।
জানতে চাইলে ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, ‘ওয়াসার লাইন থেকে বাসাবাড়িতে যে পানি দেয়া হয় তা দুর্গন্ধযুক্ত। এই পানি ফুটিয়েও পান করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে জারের পানি ক্রয় করছি। দোকান থেকে বোতলের পানি কিনে খাওয়ার সাধ্য আমার নেই। অননুমোদিত জারের পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা প্রভাবশালীদের কাছে অনেকটাই অসহায়।
অবৈধভাবে কারখানা বসিয়ে দূষিত পানি মানুষকে খাওয়ানো এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছ থেকেই বাধা আসে বলে জানান বিএসটিআইয়ের একাধিক কর্মকর্তা। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ তো দূরের কথা পিছটান দিতে হয় তাদের। যদিও বিএসটিআইয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে তৎপর তারা। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে অনুমোদিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে রাখছে।
বিষয়টি নিয়ে বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে জারের পানি বিক্রির জন্য আমাদের পক্ষে থেকে গুণগতমানের সনদ দেয়া হয়। তারা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছেন কি-না সে বিষয়ে তাদের সবসময় মনিটরিং করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জারে না কি খরচ বেশি আসে। যারা ব্যবসা করেন, তারা তো বেশি নেবেই। গুণগতমান ভালো হলেই তার মূল্যটা একটু বেশিই হয়। আমাদের লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ৩০ টাকায় এক জার পানি বিক্রি করা কঠিন হবে বলে জানান তিনি।