এপ্রিল ১০, ২০২২, ০৬:৫৫ পিএম
রাজধানীর শাহবাগ থেকে গুলিস্তান। রিকশায় যাতায়াত করা যেত না একসময়। সচিবালয়ের সামনে দিয়েও চলত না রিকশা। এখন চলছে ২৪ ঘণ্টাই। ঢাকায় একমাত্র রুট এয়ারপোর্ট থেকে শাহবাগ। যে রুটে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত রিকশা চলে না। নতুবা ঢাকার সব রুটেই রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছেই। এসব রিকশা যখন যানজটের কারণ তখনো নতুন করে দুই লাখ ১৫ হাজার রিকশার লাইসেন্স দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
এর আগে ছিল ৮৫ হাজার। একইভাবে যদি উত্তর সিটিও সমপরিমাণ রিকশার অনুমোদন দেয় তাহলে যানজট বৃদ্ধি পাবে আরও কয়েকগুণ— বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া ঢাকায় অনুমোদিত বাণিজ্যিক সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ১৫ হাজার। অথচ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এবং ঢাকা জেলার নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেট অটোরিকশাসহ আরও ২৫ হাজার চলে অতিরিক্ত।
এসব ছাড়া ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন ঢাকায় ঢুকছে আরও বেশ কিছু গাড়ি। এটাও যানজটের কারণ। এসব গাড়ির থামানোর যেমন উদ্যোগ নেই, নেই সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ। উন্নয়ন মহাযজ্ঞ ছাড়াও আরও অসংখ্য কারণে দিনকে দিন চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। যদিও নিরসনে নেই আপাত কোনো সম্ভাবনা। আবার সিটির বর্তমান প্যাটার্নও সম্ভব নয়, যে কারণে চাইলেও এখন আর যানজট নিরসন সম্ভব নয়— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
নগর পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রিটিশ আমলের ঢাকা মূলত গড়েই উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ব্রিটিশরাও তৎকালে ভাবেনি যে, ঢাকা একদিন মেগাসিটি হবে। শুরুতেই যা অপরিকল্পিত এখনো তা হচ্ছে না পরিকল্পিতভাবে। ঢাকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বসতবাড়ি সব কিছুতেই রয়েছে পরিকল্পনার অভাব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেখানে একটি পরিকল্পিত শহরের ২৫ শতাংশ জমি বরাদ্দ রাখা হয় যান চলাচলের জন্য, সেখানে ঢাকায় ব্যবহার হচ্ছে মোট আয়তনের মাত্র ৯ শতাংশ। এ অবস্থারও আশু সমাধানের সম্ভাবনা নেই। কেননা ঢাকার সড়কগুলোকে প্রশস্ত করার কোনো সুযোগ নেই, নেই নতুন করে রাস্তা নির্মাণেরও অবকাশ।
বরং বিভিন্ন ধরনের দখলদারি, অবৈধ পার্কিং ও রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখার কারণে রাস্তাগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এ ছাড়াও যানজটের অন্যতম আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে বুয়েটের এআরআই বলছে, কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। বছর শেষে যানজটে এ ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
২০১৮ সালে যানজটে দিনে নষ্ট হতো ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। সেসময় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। গত এক দশকে ঢাকায় বাস-মিনিবাসের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল বেড়েছে কয়েকগুণ।
২০১১ থেকে ২০২১ সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় আটগুণ। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা তিন লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি, যা ২০১০ সালে ছিল এক লাখ ৭৮ হাজার। একই সময়ে ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ বেড়েছে প্রায় ছয়গুণ।
২০১০ সালে ঢাকায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩১৩। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৪৮৪টিতে। অর্থাৎ বাসও দ্বিগুণ হয়েছে। এরই মধ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ১৪টি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে। নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর এক হাজার ৪০০ ভেহিক্যাল (মোটরসাইকেল কিংবা প্রাইভেটকার) চালানোর কথা থাকলেও কার্যত মহানগরীতে চলছে অন্তত ১০ লাখ মোটরসাইকেল। এসবের নিবন্ধন দিয়ে সরকার এক হাজার ৪০০ গাড়ি থেকে রাজস্ব পেলেও বাকি সব চলছে নিবন্ধন ছাড়াই। আপাতদৃষ্টিতে ঢাকার মানুষ যে সেবা পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি ভুগছে যানজটের অসহ্য ভোগান্তি।
ফিটনেসবিহীন যানবাহন— ঢাকা মহানগরীতে চলাচল করে বিভিন্ন কোম্পানিভিত্তিক গাড়ি। এর মধ্যে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত বিআরটিসির ৩০টি, ট্রান্স সিলভার ৫০টি। ট্রান্স সিলভার ৫০টি গাড়িই পুরাতন, রঙ করা। ফিটনেসবিহীন এমন চকচকা গাড়ি দিয়ে যানজট নিরসন সম্ভব নয় বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন অসংখ্য কোম্পানির ব্যানারে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি।
যানজটের আরেকটি অন্যতম কারণ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি। ওয়াসা, টিএন্ডটি, তিতাসসহ একাধিক সংস্থা। উন্নয়ন কাজের অংশ হিসেবে কোথাও কাজ শুরু করার আগে অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে নেই সমন্বয়। অথচ চিঠি দিয়ে অবহিত করা, মিটিং করে জানা যে সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো সংস্থার প্রকল্প আছে কী না? যদি থাকে তাহলে উভয়ের সমন্বয়ে একবারেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা। বাস্তবতা হচ্ছে, তিতাস কাটার একমাস পর টিএন্ডটি সড়ক কাটছে, টিএন্ডটি কাটার একমাস পর ওয়াসা কাটছে। মোট কথা, উন্নয়কাজে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাই যানজট ও ভোগান্তির অন্যতম কারণ।
সরকার নিবন্ধিত ফেডারেশন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন বলেন, রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি-আরটিসিগুলোও সক্রিয় নয়। মেট্রো আরটিসিগুলো যদি সঠিকভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করে, মিটিং করে তাহলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। বাস্তবতা হলো— এক বছর-দুই বছর আরটিসিতে কোনো মিটিংই থাকে না। আবার আরটিসিতে মেম্বার করা হয় তাদের যাদের পরিবহন সম্পর্কে বা নগরী সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না। তিনি বলেন, রমজানে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা বন্ধ।
অথচ বিকাল ৫টায় যখন বন্ধ হবে সিএনজি স্টেশন, তখন একটা চালক তিনটা থেকেই গ্যাস নেয়ার প্রস্তুতি নেয়। যে কারণে দুপুর থেকেই চালকরা গ্যাস নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে সড়কে দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি করে। এছাড়া ঢাকায় যত সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন আছে, কারোই নিজস্ব জমি নেই। জমিগুলো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তাদেরকে বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো পার্কিং নেই। ৫০টি গাড়ি স্টেশনে রাখার জায়গা নেই। গাড়ি দাঁড়াচ্ছে রাস্তায়।
এছাড়া বলা হচ্ছে, পাতাল রেল যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ, তখন যানজট কমবে। অথচ এর আগে ২০ বছর লাগবে, এই সময়ে নগরীর অবস্থা কি হবে প্রশ্ন হানিফ খোকনের। ট্রাফিক সিগন্যালও মান্ধাতার আমলের। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও দেখা গেছে, ট্রাফিক হাত উঠানোর পর ঘুমিয়ে পড়ছে। একদিকে আধা ঘণ্টা ধরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, অপর দিকে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
ট্রাফিক সিগন্যালের ডিজিটাল করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। যারা বেপরোয়া ড্রাইভ করে তাদের জন্য সিসিটিভির ব্যবস্থা করা। ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগন্যাল দেয়, কাগজপত্র দেখে, মামলা করে। সেখানেও যানজট হচ্ছে। অথচ কে ক্রাইম করল সিসি ক্যামরোয় ধরা পড়বে এবং তার ঠিকানা অনুযায়ী মেসেজ চলে যাবে— এটা নিয়ম হওয়ার কথা বলেন হানিফ খোকন।
বিআরটিএ। ঢাকায় বিআরটিএর মাত্র ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট। ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে লাখ লাখ যানবাহনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা কোনো দিনও সম্ভব নয়। তারাও আবার মোবাইল কোর্ট করে মাত্র তিনঘণ্টা। এছাড়া লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির বিরুদ্ধেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার আগেই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে কবে মোবাইল কোর্ট। গাড়ির চালক মালিকরাও ঘোষিত দিনে গাড়ি বন্ধ করে রাখেন।
সেখানে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না উল্টো সৃষ্টি হচ্ছে জনগণের দুর্ভোগ। সচিবালয়। বিকেল ৪টা থেকে বিআরটিসির ডাবল ডেকার বাসগুলো সারিবদ্ধভাবে রেখে দেয়া হয়। অথচ বিআরটিসির গাড়ি চড়ার কথা জনগণের। সচিবালয়ের স্টাফরা কেন বিআরটিসিতে চড়বে। বিআরটিসি জনগণের সেবার জন্য কেনা, আবার রেখে দেয় জনগণের চলার রাস্তায়। দুর্ভোগ দেশের জনগণের বলছেন শ্রমিক নেতা হানিফ খোকন।
সড়কের নকশাগত ত্রুটি, নির্মাণ ত্রুটি তো রয়েছেই। আগামী ডিসেম্বরে চাল হচ্ছে মেট্রোরেল। আাাগারগাঁও পর্যন্ত আসবে। প্রত্যেকটি স্টেশনে মিনি টার্মিনালের পরিকল্পনা নেই। স্টেশনগুলোতেও এলোপাতাড়ি বাস থামবে যাত্রী পরিবহনের জন্য। এসব নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই নেই। এ ছাড়া হকারদের রাস্তা দখল, গাড়ির শোরুমগুলোতে সড়কের অংশে গাড়ি প্রদর্শন, ফুটপাতে নির্মাণসামগ্রী রাখাও যানজটের অন্যতম কারণ।
সরকার উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল নির্মাণে যতটা জোর দিয়েছে তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি না থাকায় ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নগরবাসীর দুর্ভোগ। গত এক দশকে ঢাকায় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নিমাণ করা হয়েছে উড়ালসড়ক। দুই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে হাতিরঝিল উন্নয়নে। কাজে লাগছে না ২০০ কোটি টাকার ট্রাফিকবাতি। হচ্ছে না ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে মেট্রোরেল, বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত উড়ালসড়ক, জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন নির্মাণ, পূর্বাচলে সড়ক ও ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন এসব প্রকল্পও চলমান আছে। এগুলোর পেছনে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
কাজ শুরুর অপেক্ষায় আছে আরও এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বিভিন্ন সড়ক ও উড়ালসড়ক প্রকল্প। পাঁচটি মেট্রোরেল ও সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনাও সরকারের আছে। কিন্তু ঢাকায় বাস বাড়ানো, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা, ঢাকা ঘিরে রিং রোড নির্মাণ, ঢাকার ভেতরে সড়ক সমপ্রসারণের বিষয়টি অগ্রাধিকারই পায়নি।