এপ্রিল ১০, ২০২২, ০৭:০০ পিএম
ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখেই ব্যস্ত ফুটপাতের (হকার) ব্যবসায়ীরা। হকারদের ঈদ ব্যস্ততা পুঁজি করে চাঁদার পরিমাণ বাড়ানো ও রাস্তার ওপর নতুন দোকান স্থাপন নিয়ে তৎপর স্থানীয় প্রভাবশালী চাঁদাবাজরা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজির মচ্ছব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, খদ্দর মার্কেট, বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেট, স্টেডিয়াম মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ঈদুল ফিতর ঘিরে বাড়ানো হয়েছে চাঁদার পরিমাণ। পুরোনো হকারদের পাশাপাশি এক থেকে তিন মাসের নতুন চুক্তিতেও বসানো হচ্ছে নতুন হকার। এসব হকারদের থেকে প্রতি ৪৫ ইঞ্চি জায়গা বাবদ নেয়া হচ্ছে ছয় হাজার থেকে আট হাজার টাকা। জায়গা বিশেষ এই চাঁদার পরিমাণ আরও বেশি।
এছাড়া প্রতি ৪৫ ইঞ্চির দোকানে বিদ্যুৎ ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে ৯০০ টাকা, খাজনার নাম করে ৯০০ টাকা, লাইন ম্যানকে ১২শ টাকা এবং পুলিশের দুর্নীতিবাজ বিপথগামীদের মাস প্রতি তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এছাড়া নতুন দোকান নিতে এককালীন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা অবধি গুনতে হচ্ছে।
ফুটপাতে ব্যবসা করা হকাররা জানান, চাঁদাবাজদের পাশাপাশি পুলিশকেও নিয়মিত টাকা দিতে হয়। স্যাররা (পুলিশ) আমাদের থেকে টাকা নেন, আবার মাল-জিনিস ফেলে দেন, কখনো মাইর দেন এবং জেলেও দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুটপাত থেকে নেয়া বিপুল পরিমাণ চাঁদার এই টাকা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী, সিটি কর্পোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পুলিশ, চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত লাইনম্যান ও তাদের সহযোগীরা ভাগ করে নেন।
এদের বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ। যদি কেউ এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন তাহলে তাকে গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা, শুনতে হয় প্রাণনাশের হুমকি। কোথাও কোথাও দেখানো হচ্ছে অস্ত্রের ভয়ভীতি। তাই বাধ্য হয়ে অনেক ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অন্যান্য বছরের মতো এবারো ঈদকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজদের বিভিন্ন গ্রুপ। এ ক্ষেত্রে ফুটপাতে হকারদের পাশাপাশি স্থায়ী ব্যবসায়ীদেরকেও গুনতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করে। দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে ঢাকার ফুটপাতের দৈর্ঘ প্রায় ৪৩০ কিলোমিটার।
ঢাকার ফুটপাতে বছরে প্রায় এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা দুই সিটি কর্পোরেশনের সম্মিলিত বাজেটের সমান। এই ফুটপাত দখল করে অবৈধ পথে হকারদের ব্যবসা চলে। ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। লাইনম্যানদের মাধ্যমে এই টাকার ভাগ চলে যায় রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলে।
ফুটপাত নিয়ে একটি মাইক্রো ইকোনমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হকার, নিন্ম ও মধ্য আয়ের ক্রেতা, পথচারী, চাঁদাবাজির কর্মী ও ছিনতাই কারী, ফুটপাত দখলকারী স্থায়ী ব্যবসায়ী এবং মাফিয়া রাজনৈতিক চাঁদাবাজ এই ছয়টি শ্রেণি শহুরে ফুটপাতের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। ফুটপাতে তৈরি হওয়া স্বল্প সংখ্যক, হকার্স মার্কেট কিছু রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট হকার নেতাকর্মী ছাড়া সাধারণ হকাররা পেয়েছে অথবা ঘুষ দেয়া ছাড়াই পেয়েছে বলে প্রমাণ নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা বিচ্ছিন্ন কোনো সমস্যা নয়। বরং বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্নীতি, মাফিয়া সিন্ডিকেট সব মিলেই এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে ফেলেছে। প্রশাসন যখন কিছু করতে চায়, তখন ফুটপাত নিয়ন্ত্রণারী অসাধু সিন্ডিকেট লবিং শুরু করে দেয়। প্রসাশন এবং সিন্ডিকেটের মধ্যে যে দরকষাকষি হয়, তার বলি হয় হকাররা।অন্যদিক দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় একটি বিশেষ শ্রেণির সংঘবদ্ধ চক্র।
অবৈধভাবে দোকান করার বিষয়ে জানতে চাইলে হকার আব্দুল মনির (ছদ্মনাম) আমার সংবাদকে জানান, ‘এই ব্যবসা দিয়েই পরিবারের রুটি-রুজি চলে। এ ব্যবসা ছাড়ারও উপায় নেই। এ বছরও চাঁদা দেয়া শুরু করেছি। এখন আর দোকান লাগাইয়া আমাগো কিছুই থাকে না। যা আয় করি দিন শেষে সবাইকে দিতে দিতে আমগো কিছুই থাকে না। পুলিশে আমাগো থেইকা টাকাও নেয়, দোকান সরাইয়া দেয়, মাইর দেয় আবার কখনো জেলেও দেয়।’
সরেজমিন গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় মার্কেট, রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, এছাড়া মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা ও পুরান ঢাকার একাধিক ফুটপাত ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নামে বেনামে সংগঠনের নামে নিয়মিত চাঁদার পাশাপাশি তোলা হচ্ছে ইফতারের খরচও।
ফুটপাতে চাঁদার অভিযোগ এবং উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন আমার সংবাদকে জানান, ফুটপাতে অবৈধ দখল এবং উচ্ছেদ নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি স্থানীয়দেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। ফুটপাতে অবৈধ দোকান উচ্ছেদে সবার দায়বদ্ধতা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন একা তো পারবে না। আমরা সকালে অভিযান পরিচালনা করলেও বিকেলেই নতুন করে এসব দোকান গড়ে ওঠে। আমাদের মাত্র দুইজন নির্বাহী মাজিস্ট্রেট থাকায় চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত অভিযান পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন খাল উদ্ধার এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতেই বেশির ভাগ সময় যাচ্ছে আমাদের কর্মকর্তাদের। এ ক্ষেত্রে আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। প্রতিবন্ধকতা অনেক রয়েছে তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
অভিযান পরিচালনার পরেও নতুন করে কিভাবে এসব দোকান পুনরায় বসছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের কাছে চিহ্নিত কোনো চাঁদাবাজ বা অবৈধ স্থাপনা পুনরায় কারা বসাচ্ছেন এমন তথ্য নেই। তবে আমরা আমাদের জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি। রমজান মাসে সাধারণত উচ্ছেদ অভিযান কম বের হয় তবুও আমরা নিয়মিত নানা জায়গায় অভিযোগ পরিচালনা করছি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে জানান, আমরা একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি কিন্তু ফলাফল দাঁড়িয়েছে সকালে উচ্ছেদ করলেও বিকেলে তারা বসেছে আবার বিকেলে উচ্ছেদ করলে রাতেই ফুটপাত দখলে চলে যায়। সামগ্রিক এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা এবং সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। তবে আশার কথা হলো, এ জাতীয় সমস্যা নিরসনে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।
পুলিশি জটিলতা এবং ভয়ভীতির কারণে অনেক হকারই মুখ খুলতে পারেন না বা উপর মহলে অভিযোগ জানাতে পারেন না, সে ক্ষেত্রে কি করণীয় এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমাদের কোনো স্তরে এ জাতীয় সমস্যা হলে তারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট থানায় অথবা জরুরি সেবায় কল করেও সহায়তা নিতে পারেন। তা ছাড়া আমাদের সব কর্মকর্তার চেইন অব কমান্ড মেইনটেইন করতে হয়, এ ক্ষেত্রে এ জাতীয় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা এড়াতে মাঠ পর্যায়েও আমাদের টিম কাজ করছে।’