Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪,

রোজার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেনাকাটায় ভোক্তাদের মিতব্যয়ী হতে হবে

মো. আতিকুর রহমান

মো. আতিকুর রহমান

মার্চ ১০, ২০২৩, ১১:২৪ এএম


রোজার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেনাকাটায় ভোক্তাদের মিতব্যয়ী হতে হবে

এবার রমজানের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। রোজায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে ক্রেতাদের কেনাকাটায় অধিক মিতব্যয়ী ও আরও বেশি সহনশীল ভূমিকা রাখতে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সকলকে উদ্যোগী হতে হবে।

যদিও বিগত করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা-এ ধরনের নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি সাধারণ ক্রেতা। রমজানের পণ্য আনতে যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য সরকার বাকিতে পণ্য আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে।

ব্যাংকগুলোকে এ সংক্রান্ত এলসি খোলার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর সুফল ব্যবসায়ীরা ভোগ করছেন। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। নিত্যপণ্যের দাম শুধু বাড়ছেই। মূল্যবৃদ্ধির প্রমাণ দিচ্ছে খোদ সরকারি একাধিক সংস্থা।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলছে, রোজায় আমদানিকৃত পণ্যের দাম আরও বাড়বে। অপরদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এখনই গড়ে পণ্যের দাম ৫৯ শতাংশ বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের প্রভাব আরও প্রকট।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কৌশল পাল্টেছে। আগে রোজা শুরু হলে দাম বাড়ত। তখন চারদিক থেকে রব উঠত। সরকারের তৎপরতা আরও বেড়ে যেত। ফলে সিন্ডিকেট বেশিদূর যেতে পারত না। এসব কারণে এখন তারা রোজার দেড়-দুই মাস আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। প্রথম রোজা পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকে। ব্যবসায়ীদের কৌশলের কারণে ক্রেতাদের সাবধান হতে বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা অনুরোধ জানিয়েছেন, কেউ যেন একসঙ্গে অনেক বেশি পণ্য না কেনে। তাদের মতে, ক্রেতারা সাবধান হলেও এখন থেকেই কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে। অন্যথায় রোজার আগে পণ্যের দাম আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের রমজান কাটবে অস্বস্তিতে।

অপরদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি থাকবে বলে জানিয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।

তবে সরকারের আরেকটি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, রোজার এক মাস ১৭ দিন আগেই গত বছরের তুলনায় আমদানি করা পণ্যের দাম গড়ে ৫৯ শতাংশ বেশি। তবে আদা সর্বোচ্চ ১১১ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিতে এলসি জটিলতা দূর করা না গেলে রমজানে পণ্যের দাম আরও বাড়বে।

এদিকে এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। তারা বলছে, রোজা এলেই সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ে। এবারও সেটাই করা হচ্ছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার সব ধরনের পণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়েনি।

সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

সভায় আমদানি পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের উপ-পরিচালক জানান, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম না বাড়লেও দেশে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করবে। এর বেশি বাড়বে না।

রমজানের আগেই সিন্ডিকেটের কবলে দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। একাধিক সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এখানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্যতেল ও মুরগির দাম। সরবরাহ ঘাটতি না থাকলেও দাম বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও বিক্রি হচ্ছে না ভোজ্যতেল। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় এসব পণ্যের দাম আরও বেশি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, পূর্বে প্রশাসনের বাজার মনিটরিংয়ের কারণে গত কয়েক বছর ধরে রমজানে দ্রব্যমূল্য তেমন একটা বাড়ানোর সুযোগ পান না পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা এখন কৌশল পালটেছেন। রমজান আসার আগেই তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেন, যাতে পরে এ নিয়ে আর প্রশ্নের মুখে পড়তে না হয়। এবারও রমজানের ঠিক আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। যা কাম্য নয়।

যদিও কথাটি সত্য, রমজানে পণ্যের সংকটের কারণেই কেবল বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে না? মূলতঃ দাম বৃদ্ধির পেছনে ভোক্তাদেরও দায় আছে। অনেকের অভিযোগ, অনেক ক্রেতাই রমজানের আগে পুরো এক মাসের বাজার করেন। এতেই সৃষ্টি হয় কৃত্রিম সংকট। চাহিদা বুঝতে পেরে লাগামহীন দাম বৃদ্ধির সুযোগ নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বিশ্লেষকদের পরামর্শ, রোজার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেনাকাটায় ভোক্তাদের আরও বেশি সহনশীল হতে হবে।

সহমর্মিতা ও আত্মসংযমের মহান শিক্ষার মাস পবিত্র রমজান। তবে এ মাসেই সবচেয়ে অসিহষ্ণু আচরণ করেন অনেকে। সপ্তাহ নয় বরং পরিবারের জন্য পুরো রমজান মাসের নিত্যপণ্য কেনেন তারা।

ক্রেতারা বলছেন, রমজানে পণ্য সংকট হওয়ার আশঙ্কা থেকে অনেকেই আগেভাগে পুরো মাসের বাজার একসঙ্গে করে ফেলছেন। আগে কিনে যদি ১০ টাকা কমে পাওয়া যায়, তাহলে তো লাভই হলো। আগে থেকে কিনে রাখলে কিছুটা সাশ্রয় হয়। রমজান এলে বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাবে।

বিক্রেতাদের অভিযোগ, কেনাকাটায় এমন অধৈর্য আচরণ পণ্যের দামবৃদ্ধিকে উসকে দেয়। তারা বলছেন, অনেকে এক মাসের বাজার একত্রে করায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে যদি ভোক্তারা বাজার না করেন, যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই যদি কিনে তাহলে পণ্যের দাম কোনোভাবেই বাড়ার সম্ভাবনা থাকে না। রোজাদারদের আরও মিতব্যয়ী হতে বলছেন বিশ্লেষকরা।

বিআইআইএসএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাজারে যদিও পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরেও পুরো ব্যবস্থাকে ঠিক রাখতে সরকারকে হিশশিম খেতে হচ্ছে। সুতরাং, এই অবস্থায় যেন আমরা মিতব্যয়ী হই। আমরা যেন বুঝেশুনে কেনাকাটা করি।

একই পরামর্শ জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইফতারিতে বেগুন কিংবা শসা খেতেই হবে, সেক্ষেত্রে আমরা ভোক্তারাই বাজারে হামলে পড়ি, বাজারকে অস্থির করে তুলি। আমাদের আরও সচেতন হওয়ার সুযোগ আছে। রমজানের প্রথম সপ্তাহের পরেই পণ্যের দাম অনেকটা স্থিতিশীল থাকে। তাই আমাদেরকে একটু ধৈর্যশীল থাকতে হবে।

ধরুন, একটি ভবনে হয়তো ২০টি পরিবার থাকে। তাদের মধ্যে কেউ একজন উদ্যোগী হয়ে সবার চাহিদা নিরুপন করে সপ্তাহে একদিন পাইকারি বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করেন, তাহলেই কিন্তু ২০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব। পাশাপাশি রমজানের চাহিদা বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের আগেভাগেই পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করা জরুরী  বলে মনে করি।

সর্বোপরি রোজার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ক্রেতাদের অধিক মিতব্যয়ী হওয়াটা অধিক জরুরী বলে মনে করি। পাশাপাশি বাজার সিন্ডিকেটদের অপতৎপরতা রুখতে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহন করা হবে এমনটিই কাম্য।

লেখক : কলামিস্ট 

Link copied!