Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪,

ভারত-জাপান সমীকরণে বাংলাদেশ

সামারা আশরাত

সামারা আশরাত

মে ১০, ২০২৩, ০৩:৪৪ পিএম


ভারত-জাপান সমীকরণে বাংলাদেশ

গত মাসের এপ্রিলে বাংলাদেশ, জাপান এবং ভারত এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রকল্প হাতে নিতে ত্রিপুরায় বৈঠক করেছে। এই বৈঠকে, জাপান বাংলাদেশে একটি সমুদ্র বন্দর এবং পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে, নেপাল এবং ভুটানে সরবরাহ চেইনসহ বাংলাদেশে একটি শিল্প কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছে।

গত এপ্রিলে ভারতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সফরের পর, জাপান সরকার তিনটি অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন অনুমোদন করেছে। এই অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর। এই সমুদ্রবন্দরটি জাপানের বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত প্রকল্প হবার মূল কারণই হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য হতে এর দূরত্ব।

এই বপন্দরটি ত্রিপুরা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। যার ফলে ভারত এবং জাপান এই বন্দর ব্যবহার করে খুব সহজেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তর বাজার ধরতে পারবে।  ভারতে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোশি সুজুকি বলেছেন, এটি ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্য একটি লাভজনক একটি প্রকল্প হতে পারে। ভারত এবং জাপান যে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী তা সর্বজনবিদিত। তাহলে ভারত-জাপান সমীকরণে বাংলাদেশের উদ্ভব কিভাবে? 

 

বাংলাদেশ ফ্যাক্টর
প্রথমত, জাপানের ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনার মূল চাবিকাঠি ভারতের উত্তর-পূর্ব। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের চাবিকাঠি। তাই, ভারত-জাপানের অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব অনিবার্য। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলটি বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ভারত এবং জাপানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত স্থান কেননা, এই অঞ্চলটির সঙ্গে নেপাল, ভুটান, চীন, মায়ানমার এবং বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ভারত এবং জাপানের অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার দেয় এবং একই সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলিতে প্রবেশাধিকার প্রদান করে। এই প্রবেশাধিকার ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
 

জাপানের জন্য ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর গুরুত্ব
ভারত-জাপান অ্যাক্ট ইস্ট ফোরামের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য জাপান ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এই পরিকল্পনায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, ভারত-জাপান যৌথ বিনিয়োগ এবং মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো মেকং নদী ব্যবস্থার দেশগুলির কাছাকাছি ভারতকে সংযুক্ত করা জড়িত৷ বাংলাদেশকে ছাড়া ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুরোপুরি সংযোগ স্থাপন অসম্ভব। বাংলাদেশের বন্দর এবং ভূখন্ড ব্যবহার না করলে জাপানের জন্যেও শুধুমাত্র শিলিগুড়ি কোরিডরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিনিয়োগ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। 
 

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হতে পারে ভূ-রাজনৈতিক গেম চেঞ্জার
মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরটি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করবে। এই মাতারবাড়ি প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর হতে যাচ্ছে যা কিনা বৃহৎ জাহাজ চলাচলে সক্ষম। এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি ২০২৭ সালের মধ্যে চালু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এবং এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে ভারতের ল্যান্ডলকড এলাকাগুলোর সঙ্গে সংযোগকারী একটি শিল্প হাব তৈরির চাবিকাঠি হবে। সমাপ্তির পরে, এটি ভারতের অনুন্নত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসাবে কাজ করা উচিত। বন্দর উন্নয়নের ক্ষেত্রে, জাপানের জন্য মাতারবাড়ির চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারেনা। কেননা, ত্রিপুরা জাপান এবং ভারতের কাছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাকৃতিক প্রবেশদ্বার। আর ত্রিপুরা রাজ্যটি, প্রস্তাবিত সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। যার ফলে এই বন্দর থেকে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন করতে কয়েক ঘণ্টা হয়তো লাগবে। অপরদিকে এই একই পণ্য কলকাতা কিংবা ভারতের অন্য যেকোনো বন্দর থেকে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পরিবহন করতে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। এই মাতারবাড়ি বন্দরটিই আঞ্চলিক রপ্তানিকারকদের জন্য একটি প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করতে পারে।

উত্তর-পূর্বে প্রধান জাপানি বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহ
উত্তর-পূর্ব ভারতে অনেক অবকাঠামোগত প্রকল্পে জাপান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাপান আসাম, মিজোরাম এবং ত্রিপুরায় সড়ক নির্মাণে সহায়তা করার প্রিকল্পনা করছে শুধুমাত্র বাংলাদেশে জাপানি সহায়তায় প্রকল্পের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য। ২০১৯ সালের পূর্বে, জাপান সরকার ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কয়েকটি চলমান এবং নতুন প্রকল্পে ২০.৭৮৪ বিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগ করেছে, যা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার সমান।

জাপান যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে তার মধ্যে রয়েছে আসামের গুয়াহাটি পানি সরবরাহ প্রকল্প এবং গুয়াহাটি পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প, আসাম ও মেঘালয়ে উত্তর-পূর্ব সড়ক নেটওয়ার্ক সংযোগ উন্নয়ন প্রকল্প, মেঘালয়ে উত্তর-পূর্ব নেটওয়ার্ক সংযোগ উন্নয়ন প্রকল্প, জৈব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বন ব্যবস্থাপনা।

সিকিমে প্রকল্প, ত্রিপুরায় টেকসই বন ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, মিজোরামে টেকসই কৃষি ও সেচের জন্য কারিগরি সহযোগিতা প্রকল্প, নাগাল্যান্ডে বন ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, ইত্যাদি। ভারতের কাছে তার অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসটেন্স (ODA) প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে, এটি ODA ঋণে অবদান রেখেছে নর্থ ইস্ট রোড নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (যার মধ্যে রয়েছে মেঘালয়ের ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫১ এবং মিজোরামের এন এইচ৫৪)।

জাপান উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মেঘালয় রাজ্যের শিলং-ডাউকি স্ট্রিপের সম্প্রসারণ ও আপগ্রেডেশন এবং ডাউকিতে (বাংলাদেশ সীমান্তে) একটি নতুন সেতু নির্মাণে সহায়তা করবে। এছাড়াও, নিপ্পন ফাউন্ডেশনের মতো বেসরকারি জাপানী সংস্থাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইম্ফল এবং কোহিমার যুদ্ধে নিহত প্রায় ৭০ হাজার জাপানি সৈন্যদের স্মরণে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরে ইম্ফল যুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে অর্থায়ন করেছে।

এছাড়াও, একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়নে, ভারত ও জাপান ভারত-জাপান অ্যাক্ট ইস্ট ফোরাম এবং ডিসেম্বর ২০১৭-এ ফোরামের প্রথম বৈঠকও প্রতিষ্ঠা করেছে। এই বৈঠকের সহ-সভাপতি ছিলেন প্রাক্তন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর এবং ভারতে জাপানের রাষ্ট্রদূত। কেনজি হিরামাতসু। ন্যাশনাল হাইওয়ে নেটওয়ার্ক, প্রোডাক্ট-লিঙ্কড ইনসেনটিভ প্রোগ্রাম এবং গতি শক্তি মাস্টার প্ল্যানের মতো বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু করা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাপানের ‘কৌশলগত স্বার্থে’ অবদান রাখে। জাপান এ প্রোগ্রাম এবং প্রকল্পগুলিকে বিভিন্ন বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা হিসাবে দেখে।

 

যৌথ সহযোগিতার লক্ষ্য
বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন না হলে এসব প্রকল্পের কোনোটিই ফলপ্রসূ হবে না। বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সংযোগকারী একটি শিল্পাঞ্চল এবং তার সাপ্লাই চেইন তৈরি হলে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে। এছাড়াও এই ধরনের সহযোগিতার আরেকটি উদ্দেশ্য হল থাইল্যান্ডেরমতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে সরে এসে  বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর জন্যেও বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা। কেননা এসব দেশের ক্রমবর্ধমান মজুরির জন্য ইতোমধ্যেই অনেক দেশ বিকল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্র খোজা শুরু করেছে।

বাংলাদেশকে ছাড়া ভারত ও জাপান উত্তর-পূর্ব ভারতে কোনো দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা বা কোনো সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে পারবে না। ভারত যখনই উত্তর-পূর্বের বিকল্প প্রবেশাধিকার তৈরি করেছে, তখনই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লাভবান হয়েছে। বাণিজ্য হোক বা নিরাপত্তা হোক সবসময়ই বাংলাদেশ ভারতের পাশে ছিল। সুতরাং, ভারতকে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে, কারণ উত্তর-পূর্ব এবং ভারত-জাপান সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ একটি অপরিহার্য উপাদান।

লেখক: পিএইচডি ফেলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!