মো. বিলাল হোসাইন
আগস্ট ৭, ২০২৩, ০৬:১৩ পিএম
মো. বিলাল হোসাইন
আগস্ট ৭, ২০২৩, ০৬:১৩ পিএম
‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ এটাকে কেবল কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সব ধরনের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সমান গুরুত্ব বহন করে এটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে উপলব্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকা দক্ষ-যোগ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এই মহান পেশায় থাকার সুবাদে-ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এমপিও-বিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।
এক. সুশিক্ষা বিস্তারে অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক জনবল এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এই পর্যায়ে যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত তারা বেশিরভাগ হয়তো অধ্যয়নরত নয়তো অবসরপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত প্রবীণ শিক্ষক। রাষ্ট্রযন্ত্র যখনই নতুন কোন শিক্ষা-ক্রম আরোপ করেন - তখন সরকারি এবং এমপিওভুক্ত সকল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এর আওতায় আনলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা।
তবে এমপিওবিহীন স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজগুলোতে লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করছে প্রতি বছর। একজন প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক যতই মেধাবী হোক না কেন তিনি কখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের সমান করে ক্লাসে সেবা দিতে পারবেন না, আর না পারাটাই স্বাভাবিক।
তবে আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হলো- শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন ‘শিক্ষাক্রম-২০২৩’ বাস্তবায়ন করার প্রয়াসে নন-এমপিও হাই স্কুলের (রেজিস্ট্রেশনকৃত-রেজিস্ট্রেশনবিহীন) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসগুলোর মাধ্যমে শিক্ষকদের তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। সেটা কতখানি বাস্তবরূপ পাবে তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে সবার।
এক্ষেত্রে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা অমাবস্যার চাঁদ দেখতে পাবে বলে আশান্বিত হলেও, এই আওতার বাহিরে থেকে যাচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা কিন্ডারগার্টেন ও কলেজগুলো (প্রশিক্ষণ সবার জন্য জরুরি)।
মোটাদাগের কথা হলো- মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত এবং এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে কারও চিন্তা-চেতনা, মর্যাদা ও স্বীকৃতি`র বৈষম্য থাকতে পারে কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের মাঝে জ্ঞান বিতরণের কাজ করা হয়, এটা বিশ্বাস করতে সংশ্লিষ্টদের সমস্যা হবে কেন?
প্রশিক্ষণবিহীন একজন শিক্ষক যত ভালোই পড়াক না কেন একটা ঘাটতি থেকেই যায়। দিনশেষে এই অপূর্ণতার ভুক্তভোগী হচ্ছে আগামীর কর্ণধার শিক্ষার্থীরা। যা দক্ষ ও যুগোপযোগী প্রজন্ম বিনির্মাণের অন্তরায় হবে। এক্ষেত্রে প্রজন্মের বৃহত্তর স্বার্থে-নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের সর্বদা প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিকল্প নেই।
দুই. নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো অবর্ণনীয় অর্থ সংকট। প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক-শিক্ষিকারা আর্থিক দৈন্যদশায় কাটে সারাবছর।
এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত মাসিক বেতন থেকে গড়ে ১২-১৫ জন শিক্ষক মাস শেষে যা পান, তা উল্লেখ করার মতো নয়।
যার কারণে দেশব্যাপী হাজার হাজার শিক্ষক- শিক্ষিকা আর্থিক দৈন্যতায় মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন। যাদের আর দশের মতোই পরিবার পরিজন নিয়ে সুখময় জীবন কাটতে মন চায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের বেতন ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। যেটা দিয়ে এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে তারা অর্ধাহারে - অনাহারে দিনাতিপাত করেন। ব্যাপারটা অনেকাংশে মানিক বন্দোপাদ্যের ভাষায়, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লিতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না ।’
মেধাবী দক্ষ জাতি বিনির্মাণে রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোর এই সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভাবার। ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানুষ গড়ার কারিগরদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে উপেক্ষা করা জাতির জন্য মোটেই সমীচীন নয়।
তিন. আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় হলো- এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষকের ঘাটতিও সুশিক্ষা বিস্তারে বড় সংকট সৃষ্টি করে। এই সংকটের নেপথ্যে গেলে দেখা যাবে মানহানিকর সম্মানী তার মূল ও একমাত্র কারণ। দু-চার মাস চাকুরি করার পর শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে হয়তো বেশি সম্মানির আশায় অন্যত্র চলে যাচ্ছেন, নয়তো এই মহান পেশাকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাচ্ছেন। এতে করে কোমলমতি- আগামীর কর্ণধাররা স্থায়ী এবং টেকসই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চার. এই এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের চরম বেহাল দশা। বিশেষ করে, গণিত ইংরেজি পড়ে আসা শিক্ষকের অভাব অবর্ণনীয় এবং অভাবনীয়। প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষকরাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ না করেই শ্রেণি কক্ষে ইংরেজি -গণিত পড়ান ( কেউ কেউ অবশ্যই অনেক ভালো সেবা দিতে সক্ষম)।
এই ক্ষেত্রেও ইংরেজি -গণিত পড়ুয়ারা শিক্ষকতা আসতে অনীহা দেখান শুধুমাত্র অপমানকর সম্মানির কারণে। যার দরুন, এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি-গণিত বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান ছাড়াই উচ্চ শিক্ষায় পদার্পণ করেন এবং এর সুদূর প্রসারী প্রভাব সমগ্র জাতির উপর পড়ছে।
পাঁচ. করোনায় ২-৩ বছর সরকারি-বেসরকারি সকল স্তরের কর্মরতরা বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন প্রণোদনার ভাগীদার হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা সেই সময় কোন প্রকার সরকারি প্রণোদনার আওতায় পড়েনি। তারা সেই সময় পরিবার পরিজন নিয়ে এক ভয়ংকর কষ্টে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়েছেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কেউ কেউ রুটি-রুজির বন্দোবস্ত করতে গিয়ে দিনমজুরে লেগে গেছেন। আবার অনেকে প্রবাসে চলে গেছেন শিক্ষকতার এই মহান পেশাকে চির বিদায় দিয়ে, এমন খবরও পত্র পত্রিকায় রিপোর্ট হতে দেখা গেছে সেই সময়। এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় চলতে পারে না।
ছয়. এছাড়া নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক বিজ্ঞানময় শিক্ষা প্রদানে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন কম্পিউটার- ট্যাব, প্রজেক্টের, ল্যাব এর সুবিধা থেকেও সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হয়। যার দরুন এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণি কক্ষে শিক্ষকরা এগুলোর ব্যাপকভাবে প্রয়োজনবোধ করলেও, সেখানে এই ব্যয়বহুল সরঞ্জামসমূহের বন্দোবস্ত করা আকাশ কুসুম কল্পনা করা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই কোমলমতি শিশুদের একটা বড় অংশ তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে উদাত্ত আহ্বান নন-এমপিও ( ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা) প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ না করে তাদেরকে পূর্ণ মাত্রায় প্রশিক্ষণের আওতায় এনে বিভিন্ন তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর সরঞ্জাম প্রদান করে এবং আর্থিক দৈন্যতা দূরীকরণের প্রতি নজর দিয়ে, পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে (করোনা- অতিমারির মতো) এই শিক্ষক জনগোষ্ঠীর সাথে মানবীয় আচরণ করলে জাতি আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে । কারণ এই খাতে এমপিওবিহীন শিক্ষকদের অবদানকে কোন কালেই অস্বীকার করা যাবে না।
তাছাড়া, এই শিক্ষক সমাজের একাংশকে উপেক্ষা করে ডিজিটাল-স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ পূর্ণতা পাবে না বললে ভুল হবে না মোটেই। কাজেই এমপিওভুক্ত এবং এমপিওবিহীন সকল প্রতিষ্ঠানকে একই স্রোতে নিয়ে আসলে জাতি উত্তর-উত্তর সমৃদ্ধ হবে বলে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করা যায়।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, বেরনাইয়া আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ শাহরাস্তি, চাঁদপুর।