Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধে দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা

হাসান আল বান্না

হাসান আল বান্না

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩, ০১:০২ এএম


ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধে দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা

কন্যাশিশুদের নিয়ে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন বলছে, দেশে গত ৮ মাসে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ২ হাজারের বেশি কন্যাশিশু। এ সময় ৭৬ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৪ কন্যাশিশু। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত তথ্য দেয়া হয়। এতে আরও জানানো হয়, গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮ মাসে ১৮৬ কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, পারিবারিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব, আগে থেকে পারিবারিক শত্রুতার জের, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের প্রমাণ না রাখার জন্য। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় এবং অনলাইন পত্রিকার সহায়তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত কিছু তথ্য নেয়া হয়েছে মাঠপর্যায় থেকে। ১৩ ক্যাটাগরির আওতায় ৫৬টি সাব-ক্যাটাগরিতে এসব তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়। ‘জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম’ যে তথ্য দিয়েছে তা শুধু কন্যাশিশুদের নিয়ে। সামগ্রিকভাবে নারীদের নিয়ে তথ্যচিত্র নিশ্চিয়ই আরও ভয়াবহ।

দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গৃহবধূ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী থেকে শুরু করে দুই-তিন বছরের কোমলমতি শিশু- কেউই রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণ থেকে। এছাড়া বলা যায় সব ধরণের শিক্ষার্থীরাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এমন ঘটনা তো অহরহই ঘটানো হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে সমাজ ও মানসম্মানের ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানান না। তখন বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। অনেক সময় এও দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক ভিডিও আকারে ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই মেয়েকে পুনরায় ধর্ষণ করা হচ্ছে কিংবা তার কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়া হচ্ছে।

একজন মেয়ে যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, তা কি আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়? পাশাপাশি ওই মেয়েটিকে বা ওই মেয়েটির পরিবারকে আমাদের ‘সমাজ’ই বা কোন চোখে দেখে থাকে, তা কি আমরা ভেবে দেখি? আমরা কি ভেবে দেখেছি, একজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর ওই ঘটনা তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ানোর ফলে তার মানসিক শান্তি থাকে না। থাকে না ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন এবং শেষ পর্যন্ত তার আত্মবিশ্বাসটুকুও দিনে দিনে লোপ পেতে থাকে।

আবার অনেক সময় অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য ঘটনা ঘটলেও ধর্ষিতা কিংবা তার পরিবার ন্যায়বিচারটুকু পর্যন্ত পান না। একটি স্বাধীন, সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে বড় লজ্জার, দুঃখের ও আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে?

যেভাবেই ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন হোক না কেন, তা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা মোতাবেক ধর্ষণের অপরাধের যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা হল- ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত কমপক্ষে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিু পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানো বা আহত করার চেষ্টা করলে ধর্ষণকারী যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

তবে শিশু ধর্ষণ বা নির্যাতন বা হত্যা বিষয়ে মামলা করে বিচার পাওয়ার চেয়ে সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই না ঘটে সে ব্যবস্থা করা অধিকতর মঙ্গলজনক। ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, আমাদের মনের অশুভ চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় সমাজে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রতিবাদ হওয়াটা খুবই জরুরি।

ধর্ষকরা অনেক সময় উপযুক্ত শাস্তি পায় না বলেই পরবর্তী সময়ে তারা আবারও বীরদর্পে ধর্ষণ করে। আর তাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে এ সমাজ, দেশ ও জাতি কলুষিত হবে। তাই ধর্ষণ রোধে প্রতিটি পরিবারে প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, যেন বড় হয়ে সে কোনোভাবেই এ পথে পা না বাড়ায়। পরিবারই শিশুর আচরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

সাম্প্রতিককালে পত্রিকার পাতা কিংবা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধির প্রবণতা আমাদের চিন্তিত করে তুলেছে। প্রতিদিন একে পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ ব্যাপারে যতই সরব, ঠিক উল্টা চিত্র পাওয়া যায় রাষ্ট্রতন্ত্র যারা পরিচালনা করছে, তাদের কাছ থেকে। প্রতিদিনই আমরা দেখছি নারী ঘরে, বাইরে কর্মস্থলে, বাসে, ট্রেনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয় নির্যাতনের পর তাকে হত্যাও করা হচ্ছে। এসব ঘটনার পরও সুষ্ঠু ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা করা যায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!