নজরুল ইসলাম
মার্চ ৩, ২০২৪, ০৪:০৭ পিএম
নজরুল ইসলাম
মার্চ ৩, ২০২৪, ০৪:০৭ পিএম
সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল রাষ্ট্র, যথাযথ কর্তৃপক্ষ, আমরা সেখান থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করেছি এমন প্রশ্ন সচেতন মহলে ঘোরপাক খাচ্ছে। দেশের জাতীয় খবরের কাগজে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত উদ্বেগ দিয়েই আজকের জনগুরুত্বপূর্ণ জনসচেতনতামূলক লেখনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেইলি রোডে যে বহুতল ভবনে আগুন লাগল, সেখানে কোনো ফায়ার এক্সিট নেই। উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার সব ভবনে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র স্থাপন এবং অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বারবার নির্দেশনা দিলেও তা মানা হচ্ছে না।
ভবন নির্মাণের সময় নিয়মকানুন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা সবসময় আমাদের স্থপতিদের অনুরোধ করি, অন্তত যখন তারা ঘর বা বিল্ডিং ডিজাইন করেন, তখন একটি ছোট খোলা বারান্দা, একটি ফায়ার এক্সিট বা বায়ুচলাচলের স্থান রাখুন। কিন্তু যেসব স্থপতি ভবন নির্মাণ করতে চান তারা ঠিকমতো নকশা করাবেন না এবং মালিকরাও এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে চান না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সঙ্গে দেশের সুস্থ সচেতন সকল মানুষ একমত।
পাঠক, বেইলি রোডে অবস্থিত ‘কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট’ ভবনে লাগা আগুনে মোট ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে কম হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আমাদের লোকজনদের অনুরোধ করে আইন মানানো অসম্ভব কাজ। আইন প্রয়োগ করতে হয়। আইনের প্রয়োগে অন্তরায় কি? আইন অমান্য করলে কি শাস্তি, মানুষ কেন রাষ্ট্রপ্রদত্ত আইন মানছে না, এর কারণ উদ্ঘাটন সময়ের দাবি। যারা দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য জ্ঞান, দেশের প্রচলিত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নীতিমালা মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে বাধা কোথায়? বাংলাদেশে কেন এর ব্যত্যয়, সরকারের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিগণ এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে অনুশীলন প্রয়োজন। এভাবে চলতে পারেনা।
পাঠক, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ লোক মনে করে আগুন দিয়ে আমরা মুরগির মাংস, গরুর মাংস রান্না করে খাই। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে চোখ বুজে শেষ টান দেওয়া, অতঃপর জানালা দিয়ে সিগারেটের শেষের অংশ আগুনসহ ফেলে দেওয়া। আগুন নিয়ে আমরা খেলি কিন্তু আগুন কী জিনিস তা উপলব্ধি করতে পারি না। আসলেই আগুন কী? আগুন হলো- সাধারণত বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে জ্বালানির কার্বন ও হাইড্রোজেনের মিলনে সৃষ্ট এক বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়া। আলোর মাধ্যমে এ রাসায়নিক বিক্রিয়া শক্তিতে প্রকাশ পায়।
আগুন ও এর ভয়াবহতা নিয়ে বছর পূর্বে একটি সচেতনতামূলক আর্টিকেল লিখেছিলাম। ঢাকা বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুন দুর্ঘটনার চিত্র দেখে আবারো এর পুনরাবৃত্তি। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনার চেষ্টা করছি, যা হয়ত সামান্যতম সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সহায়ক হবে।
পাঠক, কেমন করে আমাদের অজান্তে আগুনের ধ্বংস লীলাখেলা সৃষ্ট হয় ইহা সরকারের যথাযথ মন্ত্রণালয় যথাযথ কর্তৃপক্ষ জানেন। উদাসীনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা, ছোট ছোট স্বার্থসংশ্লিষ্টতার সঙ্গে আপোষহীন মনোভাব তৈরি না করতে পারাই আগুন দ্বারা সৃষ্ট দুর্ঘটনা বাংলাদেশে এলোমেলোভাবে ঘটছে। আইন অনুযায়ী ভবনের প্রতিটি ঘরে স্মোক ডিটেক্টর স্থাপন করতে হবে। ধোঁয়া বের করার ডিভাইসগুলি ডিজাইন এবং ইনস্টল করা প্রয়োজন যাতে তারা আগুন বা ধোঁয়ার প্রথম দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়, অনেক লোক বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়েছিল কারণ পালিয়ে যাওয়ার কোনও পথ ছিল না। একটু স্টাডি করে দেখলাম বিল্ডিং কোড বলে যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছয় তলা হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, ঢাকা মেট্রোপলিস বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন রুলস ২০০৮ একটি সিঁড়ি এবং প্রস্থানসহ ১০ তলা আবাসিক ভবনের অনুমতি দেয়।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেছেন, তারা সড়কে থাকা সব ভবন মালিককে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়বার অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে চিঠি দিলেও কেউ তা মানেনি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী এস এম রেজাউল করিম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ঢাকার প্রায় ৬৬ শতাংশ ভবন বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করছে। সংসদে তিনি এ তথ্য জানান। রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলছেন, প্রকৃত শতাংশ জরিপের চেয়ে বেশি। বিএনবিসি প্রণয়নের সাথে জড়িত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছেন, যদিও অধিকাংশ ভবন মালিক বিএনবিসির নিয়মকানুন মানেন না, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। আইন অনুযায়ী, বিল্ডারদের ফায়ার সার্ভিস সহ ১১ টি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়, তবে বেশিরভাগই তা করে না। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন বিল্ডিং ও বাসাবাড়িতে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। এ কারণেই অগ্নি দুর্ঘটনার সময় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে নিয়ে আসা যায় না। দেশের অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোন ভবন বা বাসাবাড়িতে অগ্নি দুর্ঘটনা ঠেকাতে বা এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে ভবন নির্মাণ পর্যায় থেকেই নিতে হবে প্রস্তুতি। আমার সংক্ষিপ্ত স্টাডির মাধ্যমে উল্লিখিত প্যারাগ্রাফে যে চিত্র ফোটে উঠেছে তা হতাশাব্যঞ্জক।
পাঠক , আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কোন ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবনে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাকটিভ সিস্টেম বা সক্রিয় ব্যবস্থা এবং অন্যটি প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অগ্নি নিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
যদি কোন ভবনে আগুন লাগে তাহলে সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো এবং সেটি ঠিক মতো কাজ করে কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করা। অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করলে কোন এক জায়গায় আগুন লাগলে পুরো ভবনের বাসিন্দারাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত তারা ভবন খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। এতে করে প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব। জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিত করা ও ব্যবহার, ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা ও ব্যবহার করা, কোন একটি ভবনে আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দিয়ে সেটি নিভিয়ে ফেলা যায় তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
পাঠক, আগুন দ্বারা সৃষ্ট দুর্ঘটনার সঙ্গে গত ২০ বছর ধরে কর্মক্ষেত্রে আমি পরিচিত। বিষয়টি আমার কাজের অংশ। প্রতিদিনই কর্তব্যরত আমাকে লন্ডন ফায়ার বিগ্রেড (LFB) অফিসারদের সঙ্গে কাজ করতে হয় যখন কোনো আগুন দুর্ঘটনার আলামত আমার কর্ম পরিমণ্ডলে সৃষ্ট হয়। আমাকে তৈরি থাকতে হয় তা মোকাবিলা করার জন্য। লন্ডনে আমি যে হাসপাতালে কাজ করি সেখানে প্রায়ই সৃষ্ট হয় ফায়ার ইন্সিডেন্ট। আমাদেরকে সমানই act করতে হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত লন্ডন ফায়ার ব্রিগেড অফিসার দ্বারা নিশ্চিত এটি সত্য বা মিথ্যা ফায়ার অ্যালার্ম।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। লন্ডনের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু অ্যাকশন একি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। দুর্ভাগ্যক্রমে যা বাংলাদেশে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের মনে রাখতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আগুন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে ততক্ষণ তা আমাদের বন্ধু। আবার একটু অবহেলার কারণে তা আবার শত্রু হতে বিন্দুমাত্র দেরি করে না। সতর্কতার অভাবে মুহূর্তেই অগ্নিকাণ্ড ভস্মীভূত করতে পারে আপনার প্রিয় সাজানো সংসার বসতবাড়ি অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠাকে। বেইলি রোডের যে বহুতল ভবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একটা এক্সাম্পল। এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে অবশ্যই তিনটি প্রধান বিষয় মাথায় রাখতে হবে-
প্রথমত: অগ্নিকাণ্ডের কারণ
দ্বিতীয়ত: এ থেকে সতর্ক থাকার নিয়ম কানুন
তৃতীয়ত: অগ্নিকাণ্ডের পর করণীয়
পাঠক, সচেতনতামূলক আলোচনা আমাকে শেষ করতে হবে। লম্বা লেখা পাঠকের জন্য অনেকটা বিরক্তির কারণ। আমরা খন্দকার মোস্তাক এবং তিশাকে নিয়ে ব্যস্ত। জানার আগ্রহ আমাদের একেবারে নেই। আপনাদের ধৈর্যচ্যুতির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। যা বলে লেখা শেষ করতে চাই- তদন্ত কমিটি গঠন হবে, রিপোর্ট দিবে, কোন বিচার হবে না এই ট্রেডিশন থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আইন না মেনে যারা বিল্ডিং বানানোর অনুমতি দিয়েছে তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হউক। বিল্ডিং মালিক রেস্টুরেন্টে যারা লাইসেন্স ইস্যু করে, খাদ্য মান নিয়ন্ত্রণ BSTI রাজউক কেহ দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। এই হৃদয় বিদারক দুর্ঘটনার জন্য দায়ি সবাইকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি।
লেখক: জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফায়ার ইন্সিডেন্ট টিম
এআরএস