Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ইফতারি প্রদর্শনের সামগ্রী নয়!

রাজু আহমেদ

রাজু আহমেদ

মার্চ ১১, ২০২৪, ০৬:৪৫ পিএম


ইফতারি প্রদর্শনের সামগ্রী নয়!
  • এক

বোধহয় ভুলে গেছেন, রোজাদারকে ইফতারি করানোর মধ্যে পুণ্য! তবে দেখানোর মধ্যে কী পাপ? জানি না। আপনার বাসায় কী কী খাবার তৈরি করলেন সেটা দেখানো অনেকটাই অরুচিকর ব্যাপার! কাউকে দেখাতে মন চাইলে তাকে পার্সোনালি দেখাতে পারেন। যেহেতু সুযোগ আছে! আপনি যা যা তৈরি করেছেন তা যদি আমার ইফতারির মেন্যুতে না থাকে, আমার সামর্থ্যে না কুলোয় এবং তাতে আমার যদি মন খারাপ হয়, যদি লোভ জন্মে, যদি নিজের ওপর ধিক্কার আসে তবে সেই দায় আপনার ওপরে বর্তাবে!

কেবল রমজানেই নয় বরং কখনোই খাবারের ছবি-ভিডিওতে ফেসবুকে শেয়ার করা কিছুটা আপত্তিকর ব্যাপার! তাও দু’একবার বিশেষ অকেশনে এটা করা যেতে পারে কিন্তু কেউ যদি খাদ্য বিক্রেতা না হয় তবে রোজ রোজ খাবারে ছবি পাবলিক পরিসরে প্রদর্শন না করাতেই কল্যাণ। নিশ্চয়ই যারা শাকপাতা দিয়ে খেতে বাধ্য হয় তারা তাদের অক্ষমতার হালতকে দেখিয়ে বেড়ায় না! যারা নিজের রান্না করা খাবার দেখায় তারা এই সমাজের বিত্তশালী! কখনো কখনো স্বাভাবিক প্রদর্শও অহংকারের পর্যায়ে উপনীত হয়। হয়ত অজ্ঞাতেই হয়। মনের মধ্যে জটিলতা নাই তারপরেও এটা হতে পারে!  সুতরাং সতর্কতাই তো বিবেকের সৌন্দর্য!

সিয়াম মানে সকল ইন্দ্রিয়ের পানাহার থেকে বিরত থাকা। আমার লোভের সাথে যে সকল ইন্দ্রিয়  সরাসরি জড়িত সেগুলো যদি আপনার প্রদর্শনীকৃত খাবারের লোভে জাগ্রত হয় তবে সে দায় আপনার। কারো মধ্যে মধ্যম পর্যায়ের সভ্যতা থাকলেও সে খাদ্যের প্রদর্শনীতে বাহাদুরি করতে পারে না। যেখানে ভুখা মানুষের দেখা মেলে, যেখানে আমিষহীন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এবং যেখানে সামর্থ্যহীন মানুষ খাদ্যের জন্য লড়াই করছে সেখানে আভিজাত্যপূর্ণ খাদ্যদ্রব্য তো দূরের  কথা, ইফতারির আগে-পরে শরবত কিংবা বেগুনির ছবি দেখানোও বিবেকহীনতার পরিচয়!

সিয়াম মানে কেবল প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস থেকে বিরত থাকা নয় বরং পাপাচার এবং কামাচার থেকেও নিজেকে দূরে রাখা। অথচ যদি ঘুষ-দুর্নীতির অর্থে রিজিকের বন্দোবস্ত হয় এবং সেসব ভক্ষণ করে রোজা রাখা হয় তবে তা কুকুরের উপোস থেকেও নিকৃষ্ট! এমন উপোষের ফুটো পয়সাও মূল্য নাই। অহংকার-দম্ভমুক্ত, লোভ-ঈর্ষামুক্ত জীবন-যাপন করতে না পারলে সে রোজা আবার কাযা-কাফফারাসহ আদায় করতে হবে। ভোগের অহমিকা থেকে মুক্ত হয়ে ত্যাগের শৌর্যে জীবনের নতুনভাবে সাজানোর রমজানই তো মোক্ষম সময়।

কাউকে ইফতারি করাতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নাই! তবে সামর্থ্যের মধ্যে ইফতারি করাতে পারলে পুণ্যের অন্ত নাই। আপনার আচরণে অন্যকোনো রোজাদারদের ক্ষতি হয় কি-না, শুদ্ধতা-পবিত্রতা নষ্ট হয় কি-না সেসব ব্যাপারে একটুআধটু নজর রাখতে হবে। কথা ও কাজ এমন হবে যা কল্যাণের পথে ধাবিত হয়। অশ্লীলতার পরিত্যাজ্য না হলে, অন্যায়-দুর্নীতি বন্ধ না করলে সেই উপোস অনেকটাই বেহুদা! সিয়ামের পবিত্রতার অন্যতম অনুষঙ্গ হালাল রিজিক! লোভ থেকে বিরত থেকে ভোগ কমিয়ে দেওয়া।

  • দুই

এই রমজানে মোটামুটিভাবে খেজুর বর্জন করেছি! বাজারে গিয়ে বুঝলাম যা যা বর্জন করা দরকার সেসবের সবগুলো বর্জন করলে আমি একা হয়ে যাবে! রমজানের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসিত। তবে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, অসাধু ব্যবসায়ীদের লম্বা হাতের ক্ষমতা এবং এক মাসেই পুরো বছরের লাভ ভাগিয়ে নেওয়ার মানসিকতায় সাধারণ মানুষ অনেকটাই জিম্মি!  ধরপাকড় হলে বুঝতে পারি, এলাচিতে ডবল ব্যবসা করছে, আগুন লাগলে জানতে পারি এক কারখানায় কী পরিমাণ চিনি মওজুদ ছিল! উৎপাদক উৎপাদন খরচ যোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে এবং ভোক্তার বাজারের ব্যাগ হাতে দেহ-দিল কাঁপছে। মুনাফা মধ্যস্বত্বভোগী এবং চাঁদাবাজদের পকেটে! ফলাফলে,  সরকারের অনেক আশ্বাস ভঙ্গের বাস্তবতায় জনগণ আস্থাহীনতার মধ্যেই সেহরি খাচ্ছে!  

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী,  রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খল বদ্ধ করে রাখা হয়!  অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড দেখে দুষ্টু জনগণ বলে, রমজানে শয়তানকে অসাধু ব্যবসায়ীদের পিঠের সাথে বেঁধে দেয়া হয়! নয়তো অমুসলিম দেশগুলোর ব্যবসায়ীরাও রমজান মাসে সীমিত পরিসরে মুনাফা করে পণ্যের সহজলভ্য নিশ্চিত করে আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের মানসিকতাতেই থাকে কীভাবে রাতারাতি ভোক্তার পকেট কেটে হরিলুট করা যায়! এতো এতো সম্পদ জমিয়ে শেষ আশ্রয় কোথায়? মাটির নিচে কিংবা প্রভুর আদালতে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে কেউ থাকতে পারবে?

  • তিন

সকল হতাশার মধ্যে আশার কথা আছে কেননা কিছু ভালো মানুষ এখনো বেঁচে আছে। ফ্রিতে সাহরি খাওয়ানো, রমজান জুড়ে টনক  টন দুধ ১০ টাকা কেজি দরে রোজাদারের কাছে বিক্রি করা, সারামাসে গরু জবাই করে কোন লাভ ছাড়া মাংস বিক্রি করা, ১ টাকা লাভে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা, লাখ লাখ মানুষের কাছে বিনামূল্যে ইফতারি পৌঁছে দেওয়ার মত মহৎকর্ম কতিপয় মহৎপ্রাণ মানুষ কর যাচ্ছে। এখানেই তো মানবতা।  সারা বছর তো ব্যবসা চলছেই। এই পবিত্র মাসে লাগামহীন ব্যবসা থেকে নিজেকে বিরত রেখে অল্প লাভে কিংবা লাভহীন পদ্ধতিতে যারা রোজাদারদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনেন তারা জনতার চোখে ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারভুক্ত হতে পারে কিন্তু রাজাধিরাজের বিচারালয়ে তাদের মত লাভবান আর কেউ নয়। ভালো আমল একদিন পাথেয় হয়ে দাঁড়াবে। রমজানের কল্যাণ আমাদের আত্মাকে পবিত্রতায় ভরিয়ে রাখুক। শুভের জন্য আমৃত্যুর লড়াইয়ে টিকে থাকার সামর্থ্য খোদায়ি বারাকাতে আসুক।

লেখক: রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।  

[email protected]

Link copied!