Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা’

কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি

কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি

জুন ৭, ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম


বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা’

ব্রিটিশ শাসন শেষে জন্ম হয় পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের। আমাদের বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। জনসংখ্যায় আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অধিকাংশ আসতো আমাদের অঞ্চল থেকে। কিন্তু যার সবটুকুই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। আমাদের অঞ্চল ছিল নিগৃহীত-নির্যাতিত। সরকারি চাকুরি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব সুযোগই পেতো পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। আমরা ছিলাম অবহেলিত। এভাবে দেড় যুগ পার করার পরে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেশ করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা।

৬ দফা আমাদের জন্য ছিলো ঐতিহাসিক একটি ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য ৬ দফা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।

ছয় দফার দাবিসমূহ হচ্ছে —
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
৩. মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৪. রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা

এই দাবি সমূহে মূলত বলা হয়েছিলো পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের কাছে থাকবে। পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি যা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বন্দুকের মাধ্যমে ৬ দফা প্রতিহতের ঘোষণা দেয়।

আইয়ুব খানের নির্যাতনের পটভূমিতে দ্রুতই ৬ দফা মানুষের সমর্থন পেতে থাকে। মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার ও ব্যাপক জনসমর্থন তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু সারাদেশ ব্যাপী ৬ দফার সমর্থনে সমাবেশ শুরু করেন। ২ মাসের মধ্যে ৮ বার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ঐ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় ও ৯ ই মে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।

বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের ফলে বাঙালিরা ফুঁসে উঠে। ৭ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী  হরতালের ডাক দেয়। হরতালের প্রতিহতের ভার পড়ে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের উপর। মোনামেয় খানের আদেশে ৭ই জুন আওয়ামী লীগের মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। শ্রমিক নেতা মনু মিয়া সহ ১১ যে সেদিন শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু সেদিনও জেলে। দুপুরের পর তিনি জানতে পারেন দেশের মানুষ ৬ দফার সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা’য় ৭ জুন সম্পর্কে লিখেছেন—

১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছেন। তাঁরা ৬-দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তাঁরা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।

পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকেরা নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। কিন্তু বাঙালি জাতি নির্যাতনের মধ্যেও ৬ দফা দাবিতে অটল থাকেন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু ও আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হয়। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানি সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

৬ দফা মূলত বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলো। ৬ দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও সাধারণ নিরস্ত্র জনগণের উপর হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৬ দফা একই সূত্রে গাঁথা।

 

লেখক:

কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি
সংসদ সদস্য-৩০৮
সদস্য- নাটোর জেলা আওয়ামীলীগ 
সাবেক সহ-সভাপতি: বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগ।

 

বিআরইউ

Link copied!