জালাল আহমদ
আগস্ট ১১, ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
জালাল আহমদ
আগস্ট ১১, ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি’র) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ৯ বছর পর ভারত থেকে ফিরছেন আজ। আসামি হিসেবে নয়, নির্বাসিত রাজবন্দি হিসেবে ‘রাজকীয়’ বেশে দেশে ফিরছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা আন্দোলনের `মুখপাত্র` হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তৎকালীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ।
গোপনে অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে তিনি আন্দোলন `চাঙ্গা` রেখেছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাঁকে আটকের জন্য খুঁজছিলেন। উত্তরার এক বন্ধুর বাসা থেকে ২০১৫ সালের ১০ মার্চ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করেন। তাঁকে ‘গুম’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী ও সাবেক এমপি হাসিনা আহমেদ।পরবর্তীতে দুই মাস পর ২০১৫ সালের ১১ মে তাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরের গলফ লিংক মাঠে ‘মানসিক বিপর্যস্ত’ অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁকে। সালাহউদ্দিন আহমদের ভাষ্য উত্তরার এক বন্ধুর বাসা থেকে তাঁকে চোখ বেঁধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ‘পরিচয়’ দিয়ে গুম করা হয়।
১১ মে সকালে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় শিলং পুলিশ স্টেশনে পুলিশের কাছে যান তিনি। পুলিশ তাকে ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ দেখে প্রথমে শিলং মানসিক হাসপাতালে,পরে শিলং সিভিল হাসপাতালে এবং সর্বশেষ শিলং শহরের বিশেষায়িত হাসপাতাল নিমগ্রিসে ভর্তি করান। মানসিক অসুস্থতার কোন ‘লক্ষণ’ পা নি চিকিৎসকরা।
মেঘালয় রাজ্যের পুলিশ ২০১৫ সালের ৩ জুন ভারতে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগ এনে বৈদেশিক নাগরিক আইনের ১৪ ধারায় সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এবং তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রথমে শিলং জেলে এবং পরে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
শিলং শহর ছেড়ে না যাওয়ার শর্তে বিজ্ঞ আদালত পরে সালাহ উদ্দিন আহমদকে জামিন প্রদান করেন। ৯ বছর ধরে খাসিয়া খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা শিলং শহরে ‘সানরাইজ গেস্ট হাউজ’ নামক একটি দোতলা ভাড়া বাড়িতে তিনি বসবাস করছেন।
মেঘালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন আহমেদকে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করে ২০১৫ সালের ২২ জুলাই মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। এই মামলায় ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সালাহউদ্দিন আহমেদকে বেকসুর খালাস প্রদান করে শিলং আদালতের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ডিজি খার সিং রায় ঘোষণা করেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের এই রায়ে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’কে সালাহ উদ্দিন আহমদকে দ্রুততম সময়ে সমস্ত রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে হস্তান্তর করার জন্য নির্দেশ দেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ যখন আদালতের রায় অনুযায়ী সে দেশের রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন ভারতের সরকার বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল করেন। জজ কোর্টের রায়েও গত বছর ফেব্রুয়ারি খালাস পেয়েছেন তিনি।
গত বছর তার পাসপোর্টের মেয়াদ না থাকায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তিনি হাতে পেয়েছিলেন ট্রাভেল পারমিট।এর মেয়াদ ছিল তিন মাস।এই সময়ে ট্রাভেল পারমিট নিয়ে দিল্লীতে গিয়ে চিকিৎসার কাজ সম্পন্ন করেন তিনি। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
২০১৮ সালে তিনি যখন ভারতের বিচারিক আদালতের রায়ে খালাস পেয়েছিলেন, তখন মেঘালয় রাজ্য সরকার তাঁকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কে চিঠি দিয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জবাব দেয়নি। `কেন্দ্রীয়` সরকারের অনুমোদন না পেলে মেঘালয় রাজ্য সরকার কোনো বিদেশিকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে না। কারণ ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় পররাষ্ট্র, অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
মেঘালয় সরকার এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল এভাবেই ‘উপরোল্লিখিত হাই প্রোফাইল’ বাংলাদেশিকে তার নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জবাব দেয়নি।এর পেছনে বাংলাদেশ বাংলাদেশ সরকারের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ তাঁর সমথর্কদের।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে সালাহউদ্দিন আহমেদের দেশে ফেরার চাবি খুলে যায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি মিলে। আজ রবিবার সকাল ১১টা ১০ মিনিটে দিল্লী থেকে ভারতীয় বিমানে (এআই২২৭) উঠে দুপুর ২টায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘ইনশাহআল্লাহ,মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আগামীকাল(আজ) রোজ রবিবার দুপুর দুই টায় ঢাকা জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করব।’
সালাহউদ্দিন আহমেদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন:
কক্সবাজারের পেকুয়ার সন্তান সালাহউদ্দিন আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়নকালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য , তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, সিনিয়র সহ-সভাপতি সহ ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আশির দশকে এরশাদের রোষানলে পড়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন অনেকবার। ৬ষ্ঠ বিসিএস পরীক্ষায় ১৯৮৫ সালে অংশ নিয়ে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বিসিএস (প্রশাসন) চাকরিতে যোগদান করেন। বগুড়া জেলা প্রশাসনে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসাবে দায়িত্বপালনকালে ১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসাবে যোগ দেন।তিনি ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। সালাহ উদ্দিন আহমেদ তখন থেকে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে নেমে পড়েন।
এরপর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।অষ্টম সংসদ নির্বাচনের পর চারদলীয় জোট বেগম খালেদা জিয়া’র নেতৃত্বে সরকার গঠন করলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাশাপাশি কক্সবাজার জেলার ‘ইনচার্জ মিনিস্টার’ হিসাবেও দায়িত্বপালন করেন তিনি। ২০০২ সালের ২৭ এপ্রিল বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলা কে ভেঙে ‘পেকুয়া’ নামক একটি আলাদা উপজেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে দুই বছরের বেশী সময় ধরে কারাগারে বন্দী থেকে ২০০৯ সালের মার্চে তিনি কারামুক্ত হন।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ কারাগারে থাকাবস্থায় সাজাপ্রাপ্ত হলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার সহধর্মিনী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ কক্সবাজার-১ আসনে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রায় ৩৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সালাহ উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৬ সালে প্রথমে কক্সবাজার কক্সবাজার জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক এবং পরে পর পর দু’বার কাউন্সিলের মাধ্যমে কক্সবাজার জেলা বিএনপি’র সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি’র জাতীয় কাউন্সিলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩ সালের মার্চে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের ডাকা আন্দোলনের `মুখপাত্র` হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ আটক হয়ে তিন মাস কারাবন্দি ছিলেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিএনপির কঠোর আন্দোলনের সময় তিনি আন্দোলনের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি ।২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা আন্দোলনের `মুখপাত্র` হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তৎকালীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। গোপনে অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে তিনি আন্দোলন `চাঙ্গা` রেখেছিলেন।গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাঁকে আটকের জন্য খুঁজছিলেন। উত্তরার এক বন্ধুর বাসা থেকে ২০১৫ সালের ১০ মার্চ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করেন। তাঁকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী ও সাবেক এমপি হাসিনা আহমেদ। পরবর্তীতে দুই মাস পর ২০১৫ সালের ১১ মে তাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরের গলফ লিংক মাঠে ‘মানসিক বিপর্যস্ত’ অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁকে। সালাহউদ্দিন আহমদের ভাষ্য "উত্তরার এক বন্ধুর বাসা থেকে তাঁকে চোখ বেঁধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য `পরিচয়` দিয়ে গুম করা হয়।
দুই মাস পর একটি প্রাইভেট কারে করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে কে বা কারা রেখে যায়। তাকে কারা অপহরণ করেছেন , দুই মাস কোথায় রেখেছিলেন এবং কারা তাঁকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে নিয়ে গেলেন এই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
ভারতে নির্বাসিত থাকাবস্থায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন সালাহউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির ভবিষ্যৎ মহাসচিব হিসেবে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
বিআরইউ