সাইফ রুদাদ
অক্টোবর ৩১, ২০২২, ০৮:৪০ পিএম
সাইফ রুদাদ
অক্টোবর ৩১, ২০২২, ০৮:৪০ পিএম
দেশে মাছ উৎপাদন হ্রাস ঠেকাতে এবং মাছের প্রজনন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বিধি নিষেধ আরোপ করে ১৯৫০ সালে “মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন-১৯৫০” প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এ আইন মানে না জেলেরা। ২০২২ সালের মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে সারাদেশে প্রায় দুই কোটি মিটার জাল বা দেড়শ কোটি টাকার জাল জব্দ করার সাথে সাথে সাড়ে তিন হাজার মৎস শিকারীকে আইনের আওতায় এনেছে প্রশাসন। যা প্রশ্ন রাখে মা ইলিশ সংরক্ষণে সরকারের পদক্ষেপ কতটা যথেষ্ট?
নদীতে যারা মাছ শিকার করে জীবন যাপন করেন, তারা নিন্মবিত্ত শ্রেণির। মাছ ধরলে চুলোয় আগুন ওঠে, না ধরলে উপোস থাকে তারা। বছরের বিভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সরকার এসব জেলেদের চাল, ডাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ নগদ অর্থ প্রদান করে থাকে। কিন্তু এরপরও নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন নদীতে হাজার হাজার জেলেকে মাছ শিকার করতে দেখা যায় প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে। শুধু যে ফাঁকি দিয়ে মাছ শিকার করে বিষয়টি মোটেও ঠিক নয়, মাঝে মধ্যে দেখা যায় প্রশাসনের উপর হামলা করে জেলেরা। কোথাও কোথাও শোনা যায় মৎস কর্মকর্তা ও দায়িত্বরত প্রশাসনের সাথে অনৈতিক লেনদেনও হয় নিষেধাজ্ঞার সময়ে। বিভিন্ন কারণে পদ্মা-মেঘনা নদীতে আমার প্রায়ই যাতায়াত করা হয়। নদীতে যাতায়াত করতে গিয়ে স্বাভাবিক সময়ে যে শ্রেণির জেলেদের দেখেছি তারা প্রশাসনের উপর হামলা করার দুঃসাহস দেখাবে না দুইটি কারণে।
প্রথমত, তারা নিতান্তই গরীব অসহায় নিন্মবিত্ত শ্রেণির। বিত্তবৈভব, সাহস, সামাজিক অবস্থা বিভিন্নভাবে হিসেব মিলানো হলেও এরা প্রশাসনের উপর হামলা চালিয়ে মাছ শিকার করবে কিংবা অনৈতিক লেনদেনের প্রস্তাব পাঠাবে এরকম দুঃসাহস তাদের নেই। এসব জেলেরা পুলিশ, আদালত তো দূরে থাকুক গ্রামের জোতদার শ্রেণির মানুষকেই অনেক বেশি ভয় করে। প্রশাসন যেখানে সাধারণত নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার করতেছে এমন অবস্থায় ধরতে পারলে আর্থিক জরিমানার চেয়ে জেল প্রদান করে বেশিরভাগ সময়। যারা গ্রামের জোতদারকে ভয় করে বাঘের মতন তারা পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের উপর হামলা চালিয়ে মাছ শিকার করে বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে বেশ।
এই ভাবনা থেকে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন যারা হামলা করেছে বা করার মানসিকতা রাখে তাদের খুঁজেছি গত বছর থেকে। অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পেয়েছি তাতে আমি রীতিমত অবাক হয়েছি। গত বছর মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের শেষ পর্যায়ে খবর পাই স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ধনকুবের, জনপ্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয় স্বজনরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষিত জেলে নিয়ে আসে ইলিশ শিকার করার জন্য। যারা নিষেধাজ্ঞার সময় দাদন গ্রহণ করে তারা সাধারণত ভাসমান শ্রমিক। এরা একেকজন বছরের বার মাসে কমপক্ষে তের প্রকারের কাজ করে থাকে। কখনো এরা মাটি কাটা শ্রমিক, কখনো ভ্যান রিক্সা চালক, কখনো ফসলি জমিতে ক্ষেত মজুরের কাজ করে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির মানুষ সাধারণত নেতৃত্ব এবং সাহস পেলে পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তন করে দিতে পারে। এসব চুক্তি ভিত্তিক জেলেরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ধনকুবের, জনপ্রতিনিধি ও তাদের নিকটজনদের থেকে উৎসাহ ও সাহস পায় বলেই প্রশাসনের উপর হামলা করার দুঃসাহস করে কেননা জেল হলে সংশ্লিষ্ট দাদনদাতারা মুক্ত করে আনবেন।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের কৃষক, জেলেদের জীবনবোধ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কৃষক তাৎক্ষণিক বেশি লাভের আশায় কখনো তার ফসলী জমিতে এমন কোনো কার্যক্রম করবে না যাতে ফসল ভবিষ্যৎ কোনো স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এদেশের জেলেদের ইতিহাস হলো, জমিদার শ্রেণির অত্যাচারে ফসলী জমি হারিয়ে নদীতে ভাসমান হওয়া। নদী কারও একার নয় বা রাষ্ট্রীয়। নদী প্রকৃতির দান, প্রকৃতি থেকে মাছ শিকার করে জেলেরা জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। নদী কিংবা নদীর মাছের ক্ষতি প্রকৃত জেলেরা কখনো চায় না। ছোটোবেলা কার্টুন কিংবা নানুর কোলে শুয়ে শোনা গল্পে শুনতাম, রূপকথার দেশের গরীব জেলে প্রতিদিন তিনটার বেশি মাছ শিকার করেন না। কেননা তার বাঁচার উপকরণ সংগ্রহ করতে তিনটা মাছের বেশি প্রয়োজন হয় না। কেউ হয়তো বলবেন, ওসব নীতিকথা রূপকথায় আছে বাস্তবে নাই। তাদের বলব রূপকথা বাস্তব ছাড়া হয় না, তাছাড়া এবছর আবুল, রহিমদ্দি, কাঞ্চনসহ প্রায় ত্রিশজন জেলের সাথে আমার একান্তভাবে আলাপ হয়েছে। যারা উত্তরাধিকার সূত্রে জেলে। আলাপে তাদের স্ত্রী সন্তানদের চিকিৎসা, পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ সব বিষয় উল্লেখ করে তারা জানিয়েছেন প্রয়োজনের তুলনায় একটি মাছও বেশি শিকার করতে চান না তারা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ শিকার হয়ে গেলে তারা ভাবেন, আজ বেশি শিকার করলে কাল কম শিকার হবে তখন না খেয়ে থাকতে হবে।
পদ্মা মেঘনায় গত বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রশিক্ষিত চুক্তিভিত্তিক জেলেরা এসেছিলেন মা ইলিশ শিকারে। প্রশাসন জেল জরিমানা করার কারণে এবছর দাদন দাতারা কৌশল কিছুটা পাল্টিয়েছেন। এবছর পদ্মা মেঘনায় যারা মা ইলিশ শিকারে নেমেছিলেন তাদের শতকরা ঘাট ভাগের বয়স চৌদ্দ থেকে ষোল বছর। দেশের প্রচলিত আইন মতে প্রশাসন অসহায় হয়ে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে বলব আমি। এসব চুক্তিভিত্তিক জেলেরা প্রতিদিন কয়েকশ টন মা ইলিশ নিধন করেছে এবছর।
নিষেধাজ্ঞার সময় মা ইলিশ মাছ ক্রেতা বিক্রেতা কারা? ক্রেতা হিসেবে সাধারণত বেশি দেখা যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হবার ছয় মাস পর পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ফ্রিজে মা ইলিশ পাওয়া যায়। বর্তমানে চা দোকান গুলোতে প্রায়ই শোনা যায়, সবই খোদার নিয়ামত, কোরবানির মাংস শেষ হতে শুরু করলে ডিমসহ ইলিশ পাওয়া যায়। বছরের একাংশ কোরবানির মাংস আরেক অংশ এক-দেড় কেজি সাইজের ডিমসহ ইলিশ। মধ্যবিত্ত ছাড়াও সব শ্রেণি পেশার মানুষই কমবেশি মা ইলিশ ক্রয় করেছেন। আসলে জনসাধারণ এখনও মা ইলিশ সম্পর্কে বিস্তারিত সচেতন নয় বলেই মা ইলিশ নিধন, ক্রয়-বিক্রয় হরদম চলেছে সব জায়গায়।
প্রকৃত মাছ ব্যবসায়ীরাও মা ইলিশ বিক্রেতা নন প্রশাসনের নজরদারিতে থাকার কারণে। অধিকাংশ বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রকৃত অর্থে মাছের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন মা ইলিশ নিধন করেন না। বরং মুনাফালোভী একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে মা ইলিশ নিধনযজ্ঞে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসন রাজনৈতিক কারণে এই মুনাফালোভীদের কাছে জিম্মি।
২৮ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরও মা ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে নদীতে। মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান কতভাগ সফল-ব্যর্থ, যারা মা মাছ শিকার করেছে, তাদের পেছনে কারা উৎসাহিত করেছেন। এসব বিষয়গুলো সরকারের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন মা ইলিশ মাছ, ঝাটকা মাছ শিকারীদের জন্য আরও কঠিন আইন প্রণয়ন করা উচিত। এছাড়াও দেশীয় আমিষ শিল্প যেন বড় ধরনের সংকটে না পড়ে সেজন্য জাতীয় সম্পদ ইলিশ সংরক্ষণের জন্য আলাদাভাবে টিম গঠন করে এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে মা ইলিশ প্রজনন ব্যবস্থা নির্ভিঘ্ন করতে যাবতীয় ব্যবস্থাকে নতুন করে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
একটি মা ইলিশ এক থেকে দশলক্ষ পোনার ডিম জন্ম দেয়। নিজেদের ভবিষ্যৎ আমিষ চাহিদার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে প্রত্যেকের স্থান থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। সবাই সচেতন হলে অতি শীগ্রই স্বাভাবিক সময়ে সর্বসাধারণের ক্রয় সীমার মধ্যে আসবে ইলিশ। সর্বপরি, প্রকৃত জেলেদের জীবন-মান উন্নয়ন করে মুনাফা লোভীদের হটিয়ে মা ইলিশ রক্ষায় বিশেষ কৌশল অবলম্বন করলে সরকার দেশের মানুষের ইলিশের চাহিদা পূরণ করে প্রত্যেক বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ইলিশ রপ্তানি খাত থেকে আয় করতে পারবে।