মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী
জুন ২৬, ২০১৯, ০১:১২ পিএম
হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। যাদের পবিত্র মক্কায় যাতায়াত ও হজের কাজ সম্পাদন করার মতো আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য আছে তাদের জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ।
এবার পবিত্র হজ জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে হজ ফ্লাইট শুরু হবে ০৪ জুলাই থেকে। তাই এবার যারা হজে যাচ্ছেন তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। এসব বিষয়কে সামনে রেখে হজযাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হলো।
হজ সফরের আগে
অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে দুই রাকাত নফল নামাজ ঘরে আদায় করুন। শুকরিয়া আদায় করুন যে, আল্লাহতায়ালা আপনাকে এমন মুবারক সফরের তাওফিক দিয়েছেন। দোয়া করুন, তিনি যেন আপনার সফর সহজ করে দেন এবং আপনার হজ কবুল করে নেন। এরপর পরিবার-পরিজন থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে যাত্রা করুন এবং তাদের জন্য দোয়া করুন এবং সবার কাছে দোয়া চান।
সব গুনাহ থেকে তওবা করুন। কারো কোনো হক বা পাওনা থাকলে তা পরিশোধ করুন। কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিন।
হজ সফর শুরু হলে
আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে প্রতিজ্ঞা করুন : জামায়াতে নামাজ আদায় করবেন, সাথী বা অন্য কারোর সাথে ঝগড়া-বিবাদ করবেন না, আপনার ব্যবহারে কেউ যেন কখনো কষ্ট না পায় সে দিকে লক্ষ রাখবেন, পাপ হয় এমন কথা বলবেন না, সঙ্গীদের মধ্যে কোনো আলেম থাকলে তার সাথে ওঠাবসা করুন এবং ইলমে দীন শিখে নিন। বিশেষ করে হজে যা আপনার প্রয়োজন তা শিখে নিন।
যেসব আসবাবপত্র সাথে নেবেন
ইহরামের কাপড় (আড়াই হাত বহরের) আড়াই গজ করে ২ পিস এবং ৩ গজ করে ২ পিস। লুঙ্গি দু’টি, গেঞ্জি দু’টি, জামা-পাঞ্জাবি তিনটি, গায়ের চাদর একটি, বিছানার চাদর ২টি, পায়জামা-প্যান্ট ২টি, গামছা-তোয়ালে একটি, স্পঞ্জ সেন্ডেল এক জোড়া, বাটি একটি, চামচ একটি, গ্লাস একটি, খাবার প্লেট একটি, ছোট আয়না।
এছাড়াও সঙ্গে রাখবেন চিরুনি, সরিষার তেল, বডি লোশন, খিলাল, মেসওয়াক অথবা ব্রাশ, টুথপেস্ট, টয়লেট পেপার, রশি ২০ গজ, ছোট হ্যান্ডব্যাগ একটি, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনসহ নিয়মিত সেবনের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, খাবার স্যালাইন ৫ প্যাকেট, সর্দি এবং জ্বরের প্রয়োজনীয় ওষুধ, ২ কেজি চিঁড়া ও ১ কেজি গুড়, তায়াম্মুমের জন্য মাটি, মোবাইল চার্জার, মাল্টিপ্ল্যাগ ও জামা আয়রনের ছোট একটি ইস্ত্রিও সঙ্গে নিতে পারেন।
মহিলা হজযাত্রীদের অতিরিক্ত আসবাব
মাথার ক্যাপ একটি, হাত ও পায়ের মোজা, সালোয়ার ২টি, কামিজ ২টি, বিছানার চাদর ২টি।
আরো কিছু পরামর্শ
হজ ক্যাম্পে যত দিন অবস্থান করবেন, আপনার মালপত্র খেয়াল রাখবেন। কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন নেয়া বাকি থাকলে অবশ্যই তা নিয়ে নিন। বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে নিন।
জেনে নিন আপনার গন্তব্য ঢাকা থেকে মক্কায়, নাকি মদিনায়। যদি মদিনায় হয় তাহলে এখন ইহরাম বাঁধা নয়; যখন মদিনা থেকে মক্কায় যাবেন, তখন ইহরাম বাঁধতে হবে। বেশির ভাগ হজযাত্রী আগে মক্কা যান। যদি মক্কা যেতে হয় তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো।
এহরাম
প্রথমে সেলাইবিহীন তহবন্দ ও চাদর পরিধান করতে হবে। তারপর হজ কিংবা ওমরার নিয়তে এহরামের দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে এবং নামাজ শেষে তালবিয়া অর্থাৎ
লাব্বায়িক আল্লাহুমা লাব্বায়িক... এ দোয়া পাঠ করতে হবে। এহরামের কাপড় পরিধান থেকে শুরু করে এ তালবিয়া শেষ করার সাথে সাথেই ইহরাম শুরু হলো বলে গণ্য করা হবে।
পুরুষের এহরাম : ১. জোরে তালবিয়া পাঠ করা সুন্নাত। ২. ইহরাম অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই মাথা ঢাকা যাবে না। ৩. সেলাই করা কাপড় পরা অবৈধ।
মহিলাদের ইহরাম : ১. মুখ ঢাকতে পারবেন না। তবে মোজা পরতে পারবেন। ২. মাথা ঢেকে রাখা জরুরি। ৩. সেলাই করা কাপড় পরিধান করা বৈধ। ৪. তালবিয়া আস্তে আস্তে পাঠ করা উত্তম।
হজ ক্যাম্প থেকে বিমানবন্দর
বিমান উড্ডয়নের সময় অনুযায়ী বিমানবন্দরে পৌঁছান। আপনার নাম-ঠিকানা লেখা ব্যাগ বা সুটকেসে কোনো পচনশীল খাবার রাখবেন না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগেই গুছিয়ে নিন। বিমানবন্দরে লাগেজে যে মাল দেবেন, তা ঠিকমতো বাঁধা হয়েছে কি না দেখে নেবেন।
মনে রাখবেন, বিমানের কাউন্টারে মাল রেখে টোকেন দিলে তা যত্ম করে রাখবেন। কারণ জেদ্দা বিমানবন্দরে ওই টোকেন দেখালে সেই ব্যাগ আপনাকে ফেরত দেবে।
বাংলাদেশ সরকারের দেয়া পরিচয়পত্র, পিলগ্রিম পাস, বিমানের টিকিট, টিকা দেয়ার কার্ড, অন্য কাগজপত্র, টাকা, বিমানে পড়ার জন্য ধর্মীয় বই ইত্যাদি গলায় ঝুলানোর ব্যাগে যত্ন করে রাখুন। সময়মতো বিমানে উঠে নির্ধারিত আসনে বসুন।
জেদ্দা বিমানবন্দর পৌঁছে
আপনার মুয়াল্লিমের গাড়ি আপনাকে জেদ্দা থেকে মক্কায় যে বাড়িতে থাকবেন, সেখানে নামিয়ে দেবে। মুয়াল্লিমের নম্বর (আরবিতে লেখা) কব্জি বেল্ট দেয়া হবে, মনে করে তা হাতে পরে নেবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দেয়া পরিচয়পত্র (যাতে পিলগ্রিম পাস নম্বর, নাম, ট্রাভেল এজেন্টের নাম ইত্যাদি থাকবে) গলায় ঝুলিয়ে রাখবেন।
জেদ্দা থেকে মক্কায় পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। চলার পথে তালবিয়া পাঠ করুন (লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...)।
মক্কায় পৌঁছে
পবিত্র মক্কা দেখামাত্রই আপনি এ দোয়া পড়বেন, হে আল্লাহ! আমাকে এ পবিত্র শহরে ইমান, নিরাপত্তা ও মঙ্গলসহকারে পৌঁছে দিন। নিরাপদে থাকার তাওফিক দিন এবং এ নগরীর সম্মান ও আদব রক্ষার তাওফিক দান করুন।
মক্কায় পৌঁছে আপনার থাকার জায়গায় মালপত্র রাখুন। বিশ্রামের প্রয়োজন থাকলে বিশ্রাম করুন। আর যখন নামাজের ওয়াক্ত হয় নামাজ আদায় করুন। বিশ্রাম শেষে দলবদ্ধভাবে ওমরার নিয়ত করে থাকলে ওমরা পালন করুন।
একটি বিষয় সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, মসজিদুল হারামে অনেক প্রবেশ পথ আছে; সব ক’টি দেখতে একই রকম। কিন্তু প্রতিটি প্রবেশপথে আরবি ও ইংরেজিতে ১, ২, ৩ নম্বর ও প্রবেশ পথের নাম আছে; যেমন, ‘বাদশা আবদুল আজিজ প্রবেশ পথ’। আপনি আগে থেকে ঠিক করবেন, কোন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকবেন বা বের হবেন। আপনার সফরসঙ্গীকেও স্থান চিনিয়ে দিন। তিনি যদি হারিয়ে যান তাহলে নির্দিষ্ট গেটের সামনে থাকবেন। এতে ভেতরে ভিড়ে হারিয়ে গেলেও নির্দিষ্ট স্থানে এসে সঙ্গীকে খুঁজে পাবেন।
পবিত্র মক্কায় পৌঁছে হারাম শরিফের সীমানায় প্রবেশ মাত্র আপনি মনে করুন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শাহী দরবারে আপনি হাজির হয়েছেন। তাই আদবের সাথে গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করুন।মসজিদুল হারামে প্রবেশ করার সময় বিসমিল্লাহ ও দরুদ শরিফ পড়ার পর ‘আল্লাহুম্মাফ তাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা’ পড়বেন।
কোনো দরজার সামনে নামাজ পড়া ঠিক নয়, এতে পথচারীর কষ্ট হয়। হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া সুন্নত। তবে ভিড়ের কারণে না পারলে দূর থেকে চুমুর ইশারা করলেই চলবে। ভিড়ে অন্যকে কষ্ট দেয়া যাবে না। কাবা শরিফ প্রথম দেখামাত্র দোয়া কবুল হয়, তাই বিগলিত অন্তরে আরো যত দোয়া আপনি করতে পারেন করুন।
মদিনা শরিফ জিয়ারত
মসজিদে নববি সম্বন্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে এক রাকাত নামাজ পড়বে, সে পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজের সওয়াব পাবে।
হজ করতে গেলে হজের আগে বা পরে মদিনা শরিফে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরিফ এবং মসজিদে নববির জিয়ারত করে এলে তাতে সওয়াব আছে।
মনে রাখতে হবে
পবিত্র মক্কা-মদিনার কোনো অসুবিধার প্রতি কিংবা সেখানকার অধিবাসীদের কোনো দোষ-ত্রুটির কথা আদৌ খেয়াল করবেন না। পরনিন্দা ও পরচর্চা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন। নিজের কারণে কারো সাথে ঝগড়া বা তর্ক হলে আগেই মাফ চেয়ে নিন।
হজের পর নেক আমলের প্রতি অধিকতর যত্নবান হওয়া একান্ত কর্তব্য। কেননা হজের পর নেক আমলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া হজ কবুলের অন্যতম আলামত।
মক্কা শরিফে ও মদিনা মুনাওয়ারায় সর্বদা অজুর সাথে থাকুন। মক্কা শরিফে মসজিদুল হারামে এবং মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করুন আর ভাবুন, এখানে আসার এমন সৌভাগ্য আর নসিব হবে কি?
বেশি বেশি আল্লাহর জিকির, তাওবা-ইস্তিগফার, তাসবিহ তাহলিল এবং কুরআন তিলাওয়াত ও দ্বীনি বই-পুস্তক অধ্যয়ন করে অতিবাহিত করুন।
আরো কিছু সাবধানতা
আরাফাতের ময়দানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে খাবার, জুস, ফুল ইত্যাদি দিয়ে থাকে। ওই সব খাবার আনতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, তাই সাবধান থাকবেন। মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায়। মক্কায়ও কিনতে পাওয়া যায়।
আরাফাতের ময়দান থেকে যদি হেঁটে মুজদালিফায় আসেন, পথে বাথরুম সেরে নেবেন। কেননা মুজদালিফার বাথরুমে অনেক ভিড় লেগে থাকে।
হজ মন্ত্রণালয় মিনার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে (যেখানে হজযাত্রীদের সহজে চোখে পড়ে) ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে বিশ্বের প্রায় ১৮টি ভাষায় বিভিন্ন জরুরি দিকনির্দেশনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচার করে। যেখানে বাংলা ভাষাও রয়েছে।
বেশির ভাগ সময় হাজীদের মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। তাই মিনাকে এক হিসেবে তাঁবুর শহর বলা যায়। চার দিকে তাঁবু আর তাঁবু। সব তাঁবু দেখতে একই রকম। মোয়াল্লেম নম্বর বা তাঁবু নম্বর জানা না থাকলে যে কেউই হারিয়ে যেতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বড় অংশ বৃদ্ধ বয়সে হজ করতে আসেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে রাখেন না। অনেকে হারিয়ে ফেলেন গন্তব্য। বাংলাদেশের পতাকা অথবা ভাষা শুনে প্রবাসী বাংলাদেশী হজকর্মীরা তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন।
এ সমস্যা এড়ানোর জন্য আপনি যে তাঁবুতে অবস্থান করবেন, সে তাঁবু চিহ্নিত করে নিন। মোয়াল্লিম অফিস থেকে তাঁবুর নম্বরসহ কার্ড দেয়া হয়; তা যত্নে রাখুন। বাইরে বের হওয়ার সময় সাথে রাখুন।
হজযাত্রী সচেতন থাকলে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। অনেক বাংলাদেশী হারিয়ে যাওয়ার কারণে হজের আহকাম বা নিয়মকানুন ঠিকমতো পালন করতে পারেন না।
মক্কা-মদিনায় প্রচুর বাংলাদেশী হোটেল আছে। মক্কার হোটেলগুলোর নাম ঢাকা, এশিয়া, চট্টগ্রাম, জমজম ইত্যাদি। এসব হোটেলে ভাত, মাছ, গোশত, সবজি, ডাল ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়। হোটেল থেকে পার্সেলে বাড়িতে খাবার নিয়ে দু’জন অনায়াসে খেতে পারেন।* মক্কা-মদিনায় প্রচুর ফল ও ফলের রস পাওয়া যায়। এগুলো কিনে খেতে পারেন।
মক্কা-মদিনায় অনেক বাংলাদেশী কাজ করেন। তাই ভাষাগত কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেনাকাটার সময় দরদাম করে কিনবেন। হজের সময় প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়, পকেটে টাকা থাকলেও যানবাহন পাওয়া যায় না।
মিনায় চুল কাটার লোক পাওয়া যায়। নিজেরা নিজেদের চুল কাটবেন না, এতে মাথা কেটে যেতে পারে। মিনায় কোনো সমস্যা হলে হজযাত্রীদের সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ হজ মিশনের তাঁবুতে যোগাযোগ করবেন।
মক্কা-মদিনা থেকে বাংলাদেশে কম খরচে ফোন করা যায় (কোনো বাংলাদেশীকে বললে দেখিয়ে দেবেন)। সৌদি আরবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চাইলে সাথে সেট নিয়ে যাবেন, ওখানে (হজ প্যাকেজ) মোবাইল সিম কিনতে পাওয়া যায়।
মক্কায় কাবা শরিফ ছাড়াও জাবাল-ই-রহমত (আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত), জাবাল-ই-নূর, মিনায় আল-খায়েফ মসজিদ, নামিরা মসজিদ, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা, জাবাল-ই-সাওর প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে দেখা যায়।
হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য রক্ষার কিছু টিপস
সৌদি আরব বেশ গরমের দেশ। দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩০-৩৫ ডিগ্রির বেশি, আর্দ্রতাও থাকে বেশি। আবার রাতের বেলা তাপমাত্রা বেশ কমে যায়। তাপমাত্রা বেশি বলে ডায়রিয়া, হিটস্ট্রোক ও ইনফুয়েঞ্জার সমস্যা দেখা দেয় খুব। একটু সচেতন হলে এ সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। নিচের বিষয়গুলো লক্ষ করুন।
যাত্রার আগেই চিকিৎসকের মাধ্যমে পুরোপুরি চেকআপ করিয়ে নিন। হজে তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়া পর্বতের মধ্যে সায়ি ছাড়া আরো অনেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় হেঁটে। এ ক্ষেত্রে হজে যাওয়ার আগে থেকে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
অনেকক্ষণ ধরে বিমানে বসে থাকার ফলে হার্ট, ফুসফুস, ক্যান্সার রোগীসহ অন্যদের পায়ে পানি জমে যেতে পারে বা পা ফুলে যেতে পারে। এ সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য বিমানে ভ্রমণের সময় রাবারের তৈরি এমন কিছু পরতে পারেন, যা পায়ের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করবে। ঢিলেঢালা জামা পরিধান করুন ও বিমানে প্রচুর পানি পান করুন। প্রতি ঘণ্টায় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ান ও হাত-পা নাড়াচাড়া করুন। পায়ের ওপর পা তুলে বসবেন না।
খেজুর এমন একটি ফল, যা যেকোনো রোগী প্রচুর পরিমাণে খেলেও কোনো সমস্যা হয় না। প্রচুর পরিমাণে খেজুর খেতে পারেন ডায়াবেটিক রোগীরাও।
মক্কা ও মদিনায় অজু করার স্থানে অজু করার পাত্রে জমজমের পানি অনেকেই পান করেন। এতে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হতে পারে। পানি পানের জন্য ওয়ান টাইম ইউজ পাত্র আছে সেগুলোতে পানি পান করুন।
খেয়াল রাখুন মাথা মুণ্ডনের সময় নাপিত আপনার জন্য আলাদা ব্লেড ব্যবহার করছে কি না। সবার জন্য আলাদা নতুন ব্লেড ব্যবহার করতে হবে।
হজের সময় যে সমস্যা বেশি দেখা দেয় তা হলো শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন। এ ক্ষেত্রে জ্বর, কাশি, গলায় খুসখুস, গলায় ক্ষত, নাক দিয়ে পানি ঝরা, শরীর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে প্রচুর পানি পান করুন। জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, গলায় ক্ষতের জন্য লবণ দিয়ে গরম পানি গড়গড়া ও গরম পানি পান করুন। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। বাইরে থেকে এসেই হাত-মুখ ধুয়ে ফেলুন।
ডায়াবেটিস রোগীরা হজে যাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার ওষুধ বা ইনসুলিন নিলে তার ডোজ পরিবর্তন করতে হবে কি না জেনে নিন। হজে থাকার সময়ও নিয়ম করে ওষুধ সেবন করুন বা ইনসুলিন নিন। সব সময় মধু বা মিষ্টিজাতীয় খাবার সাথে রাখুন। যদি আপনার অতিরিক্ত দুর্বলতা, অতিরিক্ত ঘাম, প্যালপিটিশন বা অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন হয় তাহলে দ্রুত মিষ্টিজাতীয় খাবার খান। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ খাওয়া বাদ দেবেন না।
হজের সময় হাজীরা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন বেশি এবং এ কারণে তাদের মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। হিটস্ট্রোক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটানা শারীরিক পরিশ্রম করবেন না বা লম্বা সময়ের জন্য হাঁটবেন না। হজের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাঝে সময় পেলেই ঠাণ্ডা জায়গায় বসে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করুন। হিটস্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দিলে ভিড় থেকে সরে যান। সুতি কাপড়-চোপড় পরিধান করতে হবে।
কিছু কিছু ওষুধ সাথে নিন। এগুলো হতে পারে কাশির ওষুধ, অ্যালার্জির ওষুধ যেমন, লোরাটিডিন, হিস্টাসিন, ডায়রিয়ার ওষুধ যেমন খাবার স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক-জাতীয় ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক ওয়েন্টমেন্ট, কাটাছেঁড়ার জন্য পভিডন আয়োডিন, স্যাভলন, ব্যান্ডেজ, কটন, প্যারাসিটামল ও কিছু ব্যথানাশক ওষুধ যেমন, ডাইকোফেনাক, কিটোরোলাক, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমিপ্রাজল।
আপনি যেসব ওষুধ নিয়মিত সেবন করেন সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশ থেকে নিয়ে যান। আপনার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র সাথে রাখুন। কোনো সমস্যা হলে হজ এজেন্ট ও সৌদি মেডিক্যাল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করুন।
পরিশেষে বলবো, হজের সফরে সর্বদা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা রাখুন। অব্যাহতভাবে দোয়া চালিয়ে যান। যেখানে কোনো সমস্যা মনে হবে অভিজ্ঞ কোনো আলেমের কাছে জেনে নিন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রত্যেকের হজকে হজ্জে মাবরুর হিসেবে কবুল করুন। আমিন!
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা, ঢাকা