Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

চলে গেল রমজান ও ঈদ, কি পেলাম কি হারালাম

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির:

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির:

এপ্রিল ১৭, ২০২৪, ০১:৫১ পিএম


চলে গেল রমজান ও ঈদ, কি পেলাম কি হারালাম

মাহে রমজান আমাদের উপর রহমত ও বরকতের মেঘমালার মতো সুশীতল ছায়া দান করেছিল, এ মাসের রোজা তাকওয়ার অনুশীলন দান করেছিল। মেহরাবগুলোতে হাফেজদের  সুমধুর তেলাওয়াতের ধ্বনি, যা মূলত মুমিনদের উদ্দেশ্যে রাহমানুর  রাহীমের আহ্বান, মস্তিষ্ককে সুশোভিত আর অন্তঃকরণকে আলোকিত করেছিল, তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ, যিকির ও দোয়া অন্তরকে আল্লাহর নৈকট্যের অনুভূতিতে সিক্ত এবং চোখে খোদাভীতির অশ্রু ঝরাচ্ছিল।

দেখতে দেখতেই এই ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে গেল।  ১ শাওয়াল ঈদ উদ্‌যাপনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নির্দেশ এবং এর মাধ্যমে বান্দা তার গোলামির পরিচয় তুলে ধরার সুযোগ পেল।

শাওয়ালের ২ তারিখ থেকে এক বছরের জন্য এই দুই নেয়ামত রমজান ও ঈদ আমাদের কাছ থেকে চলে গেল। যদি হায়াত পাই আর আল্লাহ তায়ালার তাওফিক হয় তাহলে আর এক বছর পর আবার এই দুই নেয়ামত আমরা ফিরে পাব। এ পর্যায়ে একজন মুমিনের ভেবে দেখা উচিত যে, রমজান ও ঈদ থেকে আমরা কী পেল আর কী কী প্রভাব ও ক্রিয়া অন্তর ও মস্তিষ্কে, বোধ ও বিশ্বাসে, কর্ম ও চরিত্রে অবশিষ্ট রইল এবং রমজানের বিদায়ে কী কী খায়ের-বরকত আমরা হারাল।

এটা বাস্তব যে, যে ব্যক্তি রমজানের হক যত বেশি আদায় করেছে, রমজানের আদব সমূহের প্রতি যত বেশি যত্নবান থেকেছে সে তার কর্মজীবনে রমজান ও ঈদের প্রভাব ও ক্রিয়া তত বেশি অনুভব করবে। আর যে ব্যক্তি ত্রুটি করেছে সে তার ত্রুটির মাত্রানুপাতে প্রভাব ও ক্রিয়াতেও ত্রুটি উপলব্ধি করবে।

রমজানের সবচেয়ে বড় প্রভাব (যদি রোজা রাখা হয়ে থাকে এবং রোজাকে গুনাহমুক্ত রাখা হয়ে থাকে) তাকওয়া, যা বান্দাকে প্রতিমুহূর্তেই আল্লাহমুখি করে,কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং অকল্যাণের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে। অকল্যাণ থেকে বিরত থাকার তাগিদ সৃষ্টি করে। তাকওয়ায় পরিপূর্ণ অন্তর নসিহত দ্বারা দ্রুত প্রভাবিত হয় এবং সামান্য সতর্ক করার দ্বারা অমঙ্গলের পথ থেকে ফিরে আসে।

আমরা যদি রোজার পুরো হক আদায় না করে থাকি তাহলে তাকওয়ার সেই বিশেষ স্তর আমাদের অর্জিত হয়নি। তবুও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। কেননা, প্রতিটি মুমিনের অন্তরে সামান্য পরিমাণে হলেও তাকওয়ার স্ফুলিঙ্গ অবশ্যই থাকে। আর রোজার মাধ্যমে তাতে কিছু না কিছু বৃদ্ধি অবশ্যই ঘটে থাকে। এখন যদি তা সযত্নে লালন করা হয় এবং সে মোতাবেক ধীরে ধীরে আমল করা হয় তাহলে এ গুণ দৃঢ়তর এবং উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকবে। গুণাবলি ও যোগ্যতাসমূহের এটাই সহজাত নিয়ম এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিকারী সৎগুণাবলির ব্যাপারে একথা অধিক সত্য এবং অধিক প্রযোজ্য।

আল্লাহ তায়ালা হাদিসে কুদসীতে নিজেই ইরশাদ করেছেন, আমার বান্দা আমার প্রতি যে-রূপ ধারণা রাখে আমি তার সাথে সেরূপ আচরণ করি এবং বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে আমি তার সঙ্গী হই। যদি সে আমাকে একাকী স্মরণ করে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। যদি সে আমাকে জামাতে সমবেত ভাবে স্মরণ করে আমিও তাকে তাদের চেয়ে উত্তম জামাতে স্মরণ করি। যদি বান্দা আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয় তাহলে আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় তাহলে আমি তার দিকে চার হাত অগ্রসর হই। আর যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে তাহলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। -সহিহ মুসলিম ২/৩৪১

এখন যদি অন্তরে কোনো নেক কাজের আগ্রহ সৃষ্টি হয় বা নেক কাজের দিকে অন্তর ধাবিত হয় তাহলে বুঝতে হবে এটি তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রভাব। এর কদর করতে হবে এবং কালবিলম্ব না করে এই আগ্রহ মোতাবেক আমল করতে হবে। তেমনি ভাবে কোনো গুনাহর ব্যাপারে যাতে আমরা দুর্ভাগ্যবশত লিপ্ত রয়েছি, যদি অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হয়, তা পরিহার করার তাগাদা যদি অন্তরে উপলব্ধি হয় তাহলে বুঝতে হবে এটা অন্তর্নিহিত তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রভাব। এর কদর করা এবং সাথে সাথেই সে গুনাহ পরিত্যাগ করত খাঁটি মনে তওবা করে নেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে কালবিলম্ব করা উচিত নয়।

মোটকথা, তাকওয়ার গুণ যার যতটুকুই অর্জিত হয়েছে তা রক্ষণাবেক্ষণ করা, সযত্নে তা লালন করা , সেটি আরো শক্তিশালী করাই হবে রমজানের নেয়ামতের যথার্থ হক ও শোকর আদায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে  তাওফিক দান করুক।

যে সব বান্দা রমজানের রোজাও রাখেনি এবং ঈদ ও ভীনজাতির মতো কেবল অনুষ্ঠান-সর্বস্ব রূপেই পালন করেছে, রমজানের শেষ দশক, যা পুরো মাসের রুহ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় সময়, একেও যারা ঈদ-মার্কেটের পেছনে ক্ষয় করেছে, তাদের কাছে এখন রমজান ও ঈদের কিছু থেকে থাকলে আছে নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক আর জুতো এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু গিফট আর ঈদ কার্ড!

তেমনি যারা রমজানের জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রোজাদারদের থেকে অন্যায়ভাবে অধিক মুনাফা লুটে সম্পদের পাহাড় গড়েছে অথবা বিতাড়িত শয়তানের শৃঙ্খলিত থাকা সত্ত্বেও যারা এই মুবারক মাসে অন্যায়-অপরাধ, দুর্নীতি-সন্ত্রাস ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল-এদের জন্য এখনও পথ খোলা রয়েছে। রাব্বুল আলামীন অসীম দয়ালু ও মেহেরবান। তাঁর দয়ার দুয়ার সব সময় বান্দার জন্য খোলা। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নোক্ত বাণীটি একটু হৃদয়ের কান দিয়ে শুনুন-আল্লাহ তায়ালা রাতে তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করেন (বান্দার তওবা কবুল করার জন্য উন্মুক্ত থাকেন) যাতে দিনের অপরাধী তওবা করে (কৃতকর্মের ব্যাপারে অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে) এবং আল্লাহ তায়ালা দিনে তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের অপরাধী তওবা করে। যত দিন না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয় (কেয়ামতের আগ পর্যন্ত এ সুযোগ অবারিত)। -সহিহ মুসলিম ২/৩৫৮

তাই কোনো রকম বিলম্ব না করে এই সূবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। খাঁটি মনে তওবা করে কল্যাণের পথে প্রত্যাবর্তন করা উচিত এবং আগামী রমজানের কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য নিজেকে তৈরি করা কর্তব্য।

শেষ কথা হল, আমরা রমজান মাসে যেমন আল্লাহর বান্দা ছিলাম এখনও আল্লাহর বান্দা। তাই তখন যেমন গুনাহ পরিহারের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতাম, নামাযের প্রতি খেয়াল রাখতাম, জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করতাম সে ধারাবাহিকতা এখনও অব্যাহত রাখা জরুরি।

গুনাহ যখনই করা হোক তা গুনাহ। তাই রমজান মাস চলে গেলে গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়া যায় এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। তাছাড়া নামাজ তো রোজার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ফরজ এবং প্রতি দিনের আমল। ইমান ও ইসলামের নিদর্শন। যে মুমিন অন্তত এটুকু চিন্তা করবে যে, নামাযের মাধ্যমে মাটি দ্বারা সৃজিত এই দুর্বল মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের দরবারে হাজিরা দিতে পারছে, তার প্রিয় প্রেমাস্পদ রহমান ও রহীমের সঙ্গে কথোপকথনে সক্ষম হচ্ছে, তার পক্ষে নামাযের ব্যাপারে কোনো শিথিলতা প্রদর্শন করা সম্ভব হবে না; বরং অতি দুর্লভ অথচ সহজপ্রাপ্তি ভেবে মনেপ্রাণে নামাযের ব্যাপারে যত্নশীল হবে।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যেককে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। মাহে রমজানের শিক্ষা, ঈদের আনন্দ, দানের হাত প্রসারিত রাখার এবং নিয়মিত ইবাদত - বন্দেগি,ভাল চিন্তা অব্যাহত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।


লেখক: গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান -গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।


বিআরইউ

Link copied!