Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪,

আইনস্টাইনের মস্তিস্ক চুরি হয়েছে কীভাবে

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

আগস্ট ২৩, ২০২২, ০২:৪৫ পিএম


আইনস্টাইনের মস্তিস্ক চুরি হয়েছে কীভাবে

বিশ্ববিখ্যাত ভর-শক্তি সমীকরণ E = mc2 এর আবিষ্কর্তা ‍‍`ফাদার অফ রিলেটিভিটি‍‍` খ্যাত নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। বিশ্বে চুরি করার মত এত জিনিস থাকতেও চুরি গেছে এ বিজ্ঞানীর মহামূল্যবান মস্তিষ্ক। তাও আবার তার মরদেহের ময়নাতদন্তের পরপরই।

১৮ই এপ্রিল, ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে অবস্থিত প্রিন্সটন হাসপাতালে পৃথিবীকে চিরতরে বিদায় জানান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। মৃত্যুর আগে তার সেবা করার জন্য যে নার্স দায়িত্বে ছিলেন, তিনি জার্মান ভাষা জানতেন না। সেই কারণে মৃত্যুর সময় আইনস্টাইনের বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো আর কখনোই জানা সম্ভব হয়নি!

কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, আইনস্টাইনের শেষ ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর যেন তার শেষকৃত্য আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে কী করতে হবে তা নিয়েও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মরদেহ যেন দাহ করে ভস্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়। এমনকি তার দেহভস্ম যেন গোপনে ছড়ানো হয়, ছিল সে নির্দেশনাও। কারণ তিনি চাননি তার শরীর নিয়ে মৃত্যুর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক কিংবা তার মৃত্যু নিয়ে বেশি মাতামাতি হোক।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আইনস্টাইনের ইচ্ছা পুরোটা পূরণ করা হয়নি। তার মরদেহের ময়নাতদন্ত করা প্যাথোলজিস্ট তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে গবেষণার জন্য তার মস্তিষ্ক সরিয়ে ফেলেন।

আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর তার মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রিন্সটন হাসপাতালের প্যাথোলজিস্ট টমাস হার্ভেকে। হার্ভের কাজ শুধু মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা থাকলেও তিনি কারো পরামর্শ ও অনুমতি ছাড়াই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।


কৌতুহলবশত হোক কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, টমাস হার্ভে চাননি পৃথিবীর এত প্রসিদ্ধ একজন মানুষের ব্রেইনটা হাতছাড়া করতে। তাই তিনি আইনস্টাইনের মৃত্যুর সাড়ে সাত ঘণ্টার মধ্যে তার ব্রেইন মাথা থেকে বের করে ফেলেন! উল্লেখ্য যে, হার্ভে কোনো মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তিনি শুধু একজন প্যাথোলজিস্ট ছিলেন।

মজার ব্যাপার হলো, তিনি শুধু ব্রেইন বের করেই ক্ষান্ত হননি! সাথে আইনস্টাইনের দুটি চোখও বের করে নিয়েছিলেন! যা পরবর্তীতে প্রিজারভেশন জারে করে আইনস্টাইনের চোখের ডাক্তার হেনরি অ্যাব্রামসের কাছে হস্তান্তর করেন। আইনস্টাইনের চোখ জোড়া এখনও নিউইয়র্কে কোনো এক সেফটি লকের ভেতর সংরক্ষিত আছে বলে ধারণা করা হয়।

ময়নাতদন্তের কয়েকদিন পর হার্ভে আইনস্টাইনের পরিবারের কাছে স্বীকার করেন যে তিনি মস্তিষ্ক চুরি করেছেন। তার পরিবারের কাছে মস্তিষ্কটি রেখে দেওয়ার অনুমতি চান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হার্ভেকে মস্তিষ্ক রেখে দেওয়ার প্রাথমিক অনুমতি দেন আইনস্টাইনের ছেলে হ্যান্স।

মস্তিষ্ক রাখার অনুমতি পেলেও হার্ভে প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরি হারান। তখন তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আগের বাড়ি ছেড়ে মহান এ বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক নিয়ে হার্ভে চলে যান ফিলাডেলফিয়ায়। এখানেই তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ককে ২৪০ টুকরো করেন। ভবিষ্যৎ গবেষণা কাজের জন্য জার দুটো তার বাড়ির বেজমেন্টে সংরক্ষণ করেন তিনি।

তবে স্বামীর এ কর্মকাণ্ড খুব একটা পছন্দ করতে পারেননি হার্ভের স্ত্রী। তিনি জারগুলো ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। ফলে হার্ভে জারগুলো নিয়ে মিডওয়েস্টে সফরে বের হন। ক্যানসাসে তিনি একটি বায়োলজি ল্যাবে মেডিকেল সুপারভাইজরের চাকরি নেন।

সেখানেই তিনি প্রথম আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। মস্তিষ্কের জারগুলোকে একটা ছোট সাইডার বাক্সে রেখেছিলেন হার্ভে। সেই বাক্স লুকিয়েছিলেন একটা বিয়ার কুলারের নিচে।

এরপর আইনস্টাইনের বিখ্যাত মস্তিষ্কের অংশ পেতে আগ্রহী বিশ্বের অন্যান্য গবেষকদের কাছে কিছু কিছু টুকরো পাঠাতে শুরু করেন হার্ভে। মিসৌরিতে যাওয়ার পর তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চার সময় মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান।

এরপর সারা জীবন যেখানে যেখানে গেছেন, তার সঙ্গে থেকেছে সেই মস্তিষ্ক। তার এ গবেষণা নিয়ে অনেকেই হাসিঠাট্টা করেছেন। কিন্তু তিনি তাতে পাত্তা দেননি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ওই মস্তিষ্কের মধ্যে কোনো এক রহস্য আছে।

কেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক এতটা মূল্যবান?

‘আইনস্টাইনের ব্রেইন সাধারণ মানুষের থেকে ভিন্ন’-এই রকম হাইপোথিসিসকে পুঁজি করে গবেষণা করা হয়েছে অনেক। আর গবেষণা শেষে হাইপোথিসিসগুলো সত্যি হয়েছে প্রতিবারই। বিশ্বজুড়ে যত গবেষকেরা আইনস্টাইনের ব্রেইনের স্লাইডগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাদের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আইনস্টাইনের ব্রেইনের সাথে সাধারণ মানুষের ব্রেইনের ভিন্নতা রয়েছে অনেকটাই।

১। সাধারণ মানুষের আইকিউ গড়ে ৯০-১১০-এর মধ্যে থাকলেও আইনস্টাইনের আইকিউ ছিলো ১৬০-১৯০ বলে দাবি করা হয়। যা কিনা একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি।

সব থেকে অবাক করার বিষয় হলো, তার আইকিউ স্বাভাবিক মানুষের থেকে অনেক বেশি হলেও তার ব্রেইনের সাইজ ছিলো সাধারণ মানুষের ব্রেইনের তুলনায় ছোট! সাধারণ মানুষের ব্রেইনের ভর যেখানে প্রায় ৩ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১৪০০গ্রাম, সেখানে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ভর প্রায় ২.৭ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১২২৫ গ্রাম!

২। আইনস্টাইনের ব্রেইনের ইনফেরিওর প্যারাইটাল অংশ (যা মানুষের ভাষা ও গাণিতিক দক্ষতাকে নিয়ন্ত্রণ করে) স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় ১৫ শতাংশ বড়! অন্যদিকে ব্রেইনের সব থেকে বড় খাদ সিলভিয়ান ফিসার যা কিনা আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে ছিলোইনা।


৩। আইনস্টাইনের ব্রেইনের সেরিব্রাল কর্টেক্স মস্তিষ্কের বাকি অংশগুলোর থেকে অনেক পাতলা ছিলো এবং এই পাতলা অংশে নিউরনের ঘনত্ব ছিলো স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি!

৪। সব থেকে বড় পার্থক্য হলো, আইনস্টাইনের ব্রেইন আসল বয়সের থেকে কম বয়স নির্দেশ করে। অর্থাৎ তার ব্রেইন তার বয়সের থেকে আরও কম বয়সীদের ব্রেইনের মত আচরণ করে। অন্যদিকে আইনস্টাইনের ব্রেইনের নিউরন ও গ্লিয়াল কোষের অনুপাত একই বয়সে মারা যাওয়া ১১ জনের সাথে তুলনা করা হয়েছিলো। এতে দেখা যায়, এই অনুপাত আইনস্টাইনের ব্রেইনে অনেক গুণ বেশি।

আইনস্টাইনের ব্রেইনের বর্তমান অবস্থা কি!

টমাস হার্ভে আইনস্টাইনের ব্রেইনের মোট ৫ বক্স স্লাইড তৈরি করেছিলেন, যার মধ্য থেকে একসেট স্লাইড বর্তমানে আমেরিকাতে অবস্থিত ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ হেলথ অ্যান্ড মেডিসিনে’ রয়েছে। বাকি ৪৬টি স্লাইড রয়েছে ‍‍`দ্য মাটার মিউজিয়াম‍‍` এ।

২০০৭ সালে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক চোর হার্ভে মারা যান৷ কোন উদ্দ্যেশ্যে যে তিনি আইনস্টাইনের ব্রেইন মাথা থেকে বের করেছিলেন, তার সঠিক জবাব কারো কাছেই নেই। তবে এই প্রসিদ্ধ মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণার ফলে আরও অনেক রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আমারসংবাদ/আরইউ

Link copied!