মে ২৬, ২০২২, ০১:১৯ এএম
দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিক্ষাউপকরণের দাম। বেড়েছে স্কুল বেতন, পরীক্ষা ফি, সেশন ফি ও ভর্তি ফি। প্রাইভেট ও যাতায়ত খরচও বেশি। একজন শিক্ষার্থীর জন্য কিনতে হয় স্কুল পোশাক, জুতা, ব্যাগসহ অন্যান্য জিনিস। এসব সামগ্রী কিনতেও গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। সব মিলিয়ে এখন একটি শিশুকে পড়াতে খরচা হচ্ছে দ্বিগুণ। তবে ক্লাসভেদে একেকজন শিক্ষার্থীর খরচ একেকরকম।
এছাড়া করোনা পরবর্তী সময়ে আয় না বাড়লেও বেড়েছে ব্যয়। ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত খরচে হিমশিমে অভিভাবকরা। স্কুল বেতনসহ অন্যান্য ফি বাড়লেও বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ অভিভাবকদের। এদিকে দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাগজের দাম। ফলে বই, কপিবই, প্রাক্টিক্যাল খাতা, বাইন্ডিং খাতা ও দিস্তা কাগজের দাম বেড়েছে। তাল মিলিয়ে বেড়েছে কলম, পেনসিল, রাবার, কাটারের দামও।
এছাড়া সাধারণ ক্যালকুলেটর, সায়িন্টিফিক ক্যালকুলেটর, জ্যামিতি বক্সসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া কালির দাম বাড়ায় বই ফটোকপি করতে হচ্ছে বেশি দামে। শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাও চরম বিপাকে পড়ছেন। মাস প্রতি যে বাজেট থাকে তার চেয়ে বেশি খরচ করছেন তারা। ফলে শিক্ষা খাতে ব্যয়ে নাভিশ্বাস উঠছে অভিভাবকদের। শিশুদের পড়াতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি চরম হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ অভিভাবকরা।
ফয়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউট, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুল, উত্তরা রাজউক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাইলস্টন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ রাজধানীর নামিদামি স্কুল-সাধারণ স্কুল ঘুরে জানা যায়, বেশ কয়েকটি বেসরকারি স্কুলের বেতন, পরীক্ষা ফি, সেশন ফি ও ভর্তি ফি বাড়ানো হয়েছে। তবে সরকারি স্কুলগুলোতে আগে যে বেতন নেয়া হতো তাই নেয়া হচ্ছে। স্কুল বেতনসহ অন্যান্য ফি বাড়লেও বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।
করোনার আগে বাচ্চাদের পড়াতে যে টাকা খরচ হতো এখন তার দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে স্কুল শিক্ষকের কাছেই প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে। প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করছেন এমন শিক্ষককের নাম বলতে চান না অভিভাবকরা। তবে প্রাইভেট খরচও বেড়েছে। যাতায়াত, টিফিন, বই খাতা-কলমসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে বহুগুণ। একেক ক্লাসের শিক্ষার্থীর একেকরকম খরচ হচ্ছে।
তবে আগে যে খরচ হতো এখন তার দ্বিগুণ হচ্ছে। সব মিলিয়ে নবম-দশম শ্রেণির একটি শিশুকে পড়াতে খরচ হচ্ছে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। আবার শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে সাত থেকে আট হাজার টাকা। অন্যদিকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা।
এদিকে, শিক্ষাউপকরণের দামও অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে। রাজধানীর বাংলাবাজার, চকবাজার, নীলক্ষেতসহ পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রাক্টিক্যাল খাতা ৪০ টাকারটা ৫০ টাকা, ৬০ টাকারটা ৭০ টাকা। কলমের ডজন প্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। রাবার ডজন প্রতি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। মার্কার পেন প্রতি পিস ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা হয়েছে। সাধারণ ক্যালকুলেটর ৮০ টাকারটা ১২০ টাকা। জ্যামিতি বক্স ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা বেড়েছে। ৩০০ পেইজের খাতা ৫০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা, ১২০ পেজের খাতা ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, কালার পেপার রিম ৩২০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। মিনি ফাইল প্রতিটি ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা।
রেজিস্ট্রার খাতা ৩০০ পেইজ ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা, ৫০০ পেইজ ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। প্লাস্টিক ও স্টিলের স্কেল ডজন প্রতি ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়াও প্রিন্ট, বই ফটোকপি, খাতা স্পাইরালেও ২০ টাক থেকে ২৫ টাকা হয়েছে। কালির দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হওয়ায় ফটোকপি করতে নিচ্ছে ৯৫ পয়সা থেকে এক টাকা ১০ পয়সা। এছাড়া কাগজের দাম বাড়ায় ফটোকপি করা বইয়ের দাম ও মূল বইয়ের দামও বেড়েছে। ফটোকপির দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।
ফয়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউটের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে অনিন্দ, একই প্রতিষ্ঠানের প্রি-১ এ পড়ছে আহনাফ। এ দুই শিক্ষার্থীর মা দৈনিক আমার সংবাদকে জানান, বেতন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এ স্কুলের পড়াশোনার মান অনেক ভালো। এতে আমরা সন্তুষ্ট। সব মিলিয়ে প্রি-১ এর বাচ্চার জন্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়। আর সপ্তম শ্রেণির বাচ্চার জন্য প্রায় ৮-৯ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। সব কিছুর দাম বাড়ায় আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
মাইলসটন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে ইফতেখার। তার মা বলেন, স্কুলের মাসিক বেতন সাড়ে চার হাজার টাকা। নমব শ্রেণিতে ছিল চার হাজার টাকা। প্রাইভেট পড়তে খরচ হচ্ছে প্রায় আট হাজার টাকা। যাওয়া-আসায় আরও তিন হাজার টাকা। এদিকে কাগজ-কলমসহ অন্যান্য সামগ্রীর দামও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজারের উপরে খরচ হচ্ছে।
সালাউদ্দিন বাবু নামের এক অভিভাবক বলেন, শিশুর স্কুল বেতন, পরীক্ষা ফি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়াও শিশুর জন্য অন্যান্য খরচ তো রয়েছে। পাশাপাশি বাসা-দোকান ভাড়া। সব মিলিয়ে শিশুকে পড়াতে গিয়ে আমি খুব বিপদে আছি। বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী দেবেন তানজিদা আক্তার নুপুর। তার বড় ভাই তানভীরও একই কথা বলেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, আমাদেরকে সিট, বই ফটোকপি করেই পড়তে হয়। আগে প্রতি কোর্সের জন্য আমাদের ছয় থেকে ৭০০ টাকার ভেতর ফটোকপি করতে পারতাম। এখন তা হাজার টাকার উপরে লাগছে।
এদিকে বাংলাবাজারের এক দোকানি বলেন, এ বছরের শুরু থেকে কাগজের দাম কয়েকবার বেড়েছে। কালি, প্লাস্টিকসহ সব কিছুর দামই বেড়েছে। সোনালি কাগজ দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। কালির দামও বেশি। তাই ফটোকপি করতে প্রতি পৃষ্ঠা এক টাকা ১০ পয়সা নিচ্ছি। আগে নিতাম ৯৫ পয়সা।
ফয়জুর রহমান আইডিয়াল ইনস্টিটিউটের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, করোনার আগে বেতন ছিল এক হাজার ২৫০ টাকা, এখন বেতন নেয়া হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকা। পরীক্ষা ফি ৩০০-৪০০ টাকা, এখন নেয়া হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা। সেশন ফি নেয়া হচ্ছে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। শিক্ষার মান কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের ভালো পড়াশোনা ও পরীক্ষায় ভালো করার জন্য সব কিছুই সিরিয়াসলি দেখছি।
দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের আলাদা গাইড টিচার রয়েছেন। মতিঝিল আইডিয়াল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে যে বেতন নেয়া হতো, এখনো তাই নেয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে বেতন নেয়া হচ্ছে এক হাজার ৩৫০ টাকা। নতুন ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীর প্রথম দুই মাসে বেতন পড়ছে চার হাজার ৫৫০ টাকা। একজন শিক্ষার্থীর ভর্তির সময় আট হাজার টাকা লাগছে যা সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে তাই নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলো নিয়ে কাজ করছেন জগন্নাথ বিশ্বদ্যািলয়ের সহকারী অধ্যাপক আফসানা আহমেদ। তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, সরকারি স্কুলগুলো যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, বেসরকারি স্কুলগুলো সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি স্কুলগুলোর জন্য যে নীতিমালা রয়েছে, সে ব্যাপারে সরকারকে আরও মনযোগী হতে হবে এবং মনিটরিং বাড়াতে হবে।
এছাড়া যেসব স্কুলের ছাত্রদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, তার একটি কারণ হচ্ছে সেসব স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কম দেয়া হয়। শিক্ষকদের ভেতর একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষাও কাজ করে। এছাড়া জিপিএ-ফাইভ পাওয়ার নামে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেটার জন্য কিন্তু কিছু শিক্ষক এবং অভিভাবকরাও দায়ী। ফলে শিশুদের ওপর একটা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয়।
তাই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক-শিক্ষকদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি। একই সাথে বেসরকারি স্কুলগুলোতে সরকারের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। ফলে মানসম্মত শিক্ষা যেমন বাড়বে তেমনি প্রাইভেট পড়া বা পড়ানোর প্রবণতাও কমে যাবে। তাতে করে শিক্ষা খরচটাও অনেকটা কমে যাবে।’