জুন ১২, ২০২২, ১২:৩৮ এএম
১৯৪৫ সালে ওই জমির মালিক বীরেন্দ্রনাথ রায়, তার সাড়ে ১৯ কাঠা জমির আম মোক্তার (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দিয়ে যান স্থানীয় সিরাজুল হককে। ২০ বছর পর ১৯৬৫-৬৬ সালে ওই জমির খাজনা দিয়ে নিজের নামে নামজারি (মিউটেশন) করান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক।
কিন্তু পরবর্তীতে খাজনা না দেয়ায় ১৯৯৯ সালে সরকার এ জমির খাজনা দাবি করে মামলা করে। এ মামলার পর ওই বছরের ২৫ জুলাই সিরাজুল হক দুই হাজার ৭৯২ টাকা খাজনা পরিশোধ করে জমির ভোগদখল করতে থাকেন। ২০০৮ সালে মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। এরপর এ জমির খতিয়ান সংশোধন চেয়ে মামলা করে রাষ্ট্রপক্ষ।
পরে ২০০৯ সালের ২৩ জুন রমনা ভূমি অফিস ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিস পাঠায়। নোটিসের পরপরই জমি অধগ্রহণের গেজেটও জারি করা হয়। গেজেট জারির কিছু দিন পর জমির ভোগদখলকারী সিরাজুল হকের পরিবারকে উচ্ছেদ করে প্রশাসন। পরে ওই গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন হাইকোর্টে ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিরাজুল হকের স্ত্রী মালেকা সিরাজ।
শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১১ সালে গেজেট বাতিল ও জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তখন চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা দেন। পরে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে ২০১২ সালে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তারপর আট বছর পেরিয়ে গেলেও মামলাটি শুনানির উদ্যোগ নেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ। তবে চলতি বছরের শুরুতে মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় থাকলেও শুনানি করেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ ফের সময় চাইলে আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ১০ বছরেও একটা মামলার প্রস্তুতি নিতে পারেন না, এটা লজ্জার। এটা হতে পারে না। তাহলে আমাদের এখানে (এজলাসে) বসে থেকে লাভ কী!
আদালত বলেন, এভাবে সময় নিলে তো সম্পত্তিতে জনগণের অধিকার থাকে না। জনগণের সম্পত্তির সুরক্ষাই যদি না থাকে, তাহলে আদালত থেকে লাভ কী?। এমন অহরহ মামলা রয়েছে যার আপিল করে আর খোঁজ রাখেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
চাঁদপুর সদর ও হাইমচরে অবস্থিত ২১টি মৌজা এলাকায় জনস্বার্থে নিজ খরচে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান।
ওই রিটের ওপর ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল রায় দেন আদালত। রায়ে চাঁদপুরের ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। চলতি বছরের ১৫ মার্চ হাইকোর্টের দেয়া ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
শুনানি নিয়ে গত ৪ এপ্রিল বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠানো হলে শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের চার বছর পর আপিল আবেদন করায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর ওপর উষ্মা প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ।
শুনানির এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রায় ঘোষণা হয়েছে ২০১৮ সালে। আর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন এক হাজার ৪৪০ দিন পর। এতদিন কি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন?’
এসময় বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ কখন ঘুমায়, আর কখন জেগে থাকে বোঝা মুশকিল।
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান আদালতকে বলেন, ‘এই ঘুমিয়ে থাকারও একটা তদন্ত হওয়া দরকার।’ শুধু সিরাজুল ও সেলিম চেয়ারম্যানের মামলাই নয়, উচ্চ আদালতে এমন অনেক মামলা আছে যেগুলো যুগের পর যুগ ঝুলে আছে। অধিকাংশ মামলা রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে চুপচাপ বসে থাকে শুনানির উদ্যোগ নেয় না। এছাড়া প্রায় এক ডজন চাঞ্চল্যকর মামলার চূড়ান্ত বিচার আটকে আছে সুপ্রিম কোর্টে।
এরমধ্যে রয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ের রিভিউ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, পিলখানা হত্যা ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা।
এছাড়া অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের পদমর্যাদা সংক্রান্ত রিটের রিভিউ আবেদন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল, পার্বত্য শান্তিচুক্তির কয়েকটি ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা, ওয়ান-ইলেভেনের সময় বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অবৈধভাবে নেয়া টাকা ফেরত প্রদান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিল ও মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যামামলা বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
এসব মামলা শুনানি না হওয়ায় বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষও শুনানির জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কোন মামলা কত বছর অনিষ্পন্ন অবস্থায় আটকে আছে সে বিষয়েও মনিটরিং নেই।
আইনজীবীরা বলছেন, শুনানির ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং আসামিপক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কবে নাগাদ শুনানি হবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। ঝুলে থাকা এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারপ্রার্থী ও আসামি উভয় পক্ষই হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বিচারপ্রার্থীরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে আসামিরাও নির্জন কারাগারের কনডেম সেলে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।
এ অবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সামনে হাইকোর্টে আরও বিচারক নিয়োগ দেয়া হবে। আশা করা যাচ্ছে নিয়োগের পর ডেথ রেফারেন্স কোর্ট আরও বাড়ানো হতে পারে। তবে কোর্ট বাড়ানোর চেয়ে ডেথ রেফারেন্স মামলায় পেপারবুক তৈরির কাজকে আরও গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে মনে করেন আইনজীবীরা। সম্ভব হলে সুপ্রিম কোর্টে নিজস্ব প্রেস থাকা দরকার বলেও মনে করেন তারা। তাহলে পেপারবুক তৈরিতে সময় ক্ষেপণ কমবে এবং ডেথ রেফারেন্স মামলার প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হবে।
অভিযোগ রয়েছে, মামলায় পেপারবুক প্রস্তুত করে শুনানির জন্য সময় ক্ষেপণ এবং ডেথ রেফারেন্স কোর্টের সংখ্যা কম হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের করা আপিল ও জেল আপিল মামলাগুলো শুনানি ঠিকমতো হচ্ছে না।
জানা গেছে, এখন হাইকোর্টে মাত্র একটি ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ রয়েছে। হাইকোর্টে কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি কোর্ট বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াই মামলাজটের অন্যতম কারণ। সেটি চাঞ্চল্যকর হোক কিংবা সাধারণ হোক। উচ্চ আদালতে এ ধরনের অসংখ্য মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বা আদালত থেকে এসব মামলা নিষ্পত্তিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। সারা দেশের অধঃস্তন আদালতগুলোতে একই অবস্থা। যে হারে মামলা আসছে, সে তুলনায় নিষ্পত্তির হার খুবই কম।
তিনি বলেন, ‘বিচারিক আদালতে যে আসামির ফাঁসির দণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, এখন তিনি যদি উচ্চ আদালতে খালাস পান, তাহলে এই যে দীর্ঘ দিন ধরে তিনি কারাগারের কনডেম সেলে কিংবা কারাকক্ষে বছরের পর বছর পার করলেন, এতে সামাজিকভাবে তার পরিবার হেয় প্রতিপন্ন হলো। এর দায় কে নেবে? তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।’
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলা বিচারিক আদালত শেষে এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। তবে এসব মামলা শুনানির উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রপক্ষকে। অনেক সময় দেখা যায়, মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে কিন্তু আর শুনানির আগ্রহ দেখায় না। এমনকি তারা খোঁজও নেয় না। ফলে মামলাগুলো বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন অবস্থায় আটকে থাকে। এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকেন বিচারপ্রার্থীরা। দ্রুত এসব মামলা শুনানির উদ্যোগ নেয়া দরকার। রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।