জুন ১২, ২০২২, ১২:৪৯ এএম
জ্যামিতিক হারে বাড়ছে দেশের জনসংখ্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য গ্রাজুয়েট বের হলেও তাদের কর্মক্ষেত্র নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের এক জরিপে উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই বেকার। ফলে চাহিদার তুলনায় কর্মসংস্থান কম থাকায় শিক্ষিতদের বড় একটি অংশ হতাশায় ভুগছেন। অনেকে আবার আত্মহননের মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। চাকরির বাজারে যে চাহিদা রয়েছে, সে রকম লোক আমরা তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতিবছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের উপযোগী চাকরি নেই।
গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, দেশে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগেও বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী শহর ও শোভন কাজ করতে চান। কিন্তু শহরে যত চাকরিপ্রার্থী প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে, সেই পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
তবে শুধুমাত্র গ্রাজুয়েটের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার দিকেই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে জনগণকে জনশক্তিতে রূপ দিতে সম্ভাবনা বাড়ছে দেশের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায়। কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের দক্ষতা নিশ্চিত করতে সরকার নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সারা দেশে উপজেলা পর্যায়ে ৩২৯টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রকল্পও শুরু করেছে সরকার।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা এবং প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নতুন শিক্ষার্থীর অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত কারিগরি স্কুল ও কলেজে সাধারণ শিক্ষার কারিকুলামে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ আলোচনাক্রমে পরবর্তীতে নিষ্পত্তি করবে। জানুয়ারি ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পরবর্তী সময়ে প্রস্তাবিত ৩৮৯টি উপজেলার মধ্যে ৬৩টি উপজেলায় এর মধ্যে টিএসসি বিদ্যমান রয়েছে। তাই দ্বৈততা পরিহারের জন্য এই প্রকল্প থেকে ওই ৬৩টি উপজেলাকে বাদ দিয়ে অবশিষ্ট উপজেলা এবং বাংলাদেশের নবসৃষ্ট যেসব উপজেলায় কোনো টিএসসি নেই বা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়নি সেখানে টিএসসি স্থাপনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
এতে করে বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি করে টিএসসি বিদ্যমান থাকবে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে- ৯৮৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয়, একাডেমিক কাম ওয়ার্কশপ ও প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষক ডরমিটরি, ছাত্রী নিবাস, বাউন্ডারি ওয়াল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, গভীর নলকূপ, ৫০০ কেভিএ সাব-স্টেশন, শহীদ মিনার, মুক্তিযোদ্ধা মনুমেন্ট এবং পানি সংরক্ষণাগার। প্রতিটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে জলাধারও নির্মাণ করা হবে বলে জানানো হবে।
এছাড়া বিশ্বমানের কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করতে একাধিক প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এসবের মাঝে আটটি বিভাগীয় সদরে আটটি মহিলা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন, টিভিইটি সেক্টরে শিক্ষকতার গুনগত মানোন্নয়ন, কক্সবাজার টিএসসি প্রাঙ্গণে কারিগরি শিক্ষক লিডারশিপ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নির্বাচিত বেসরকারি কারিগরি স্কুল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে আইসিটির উন্নয়ন, বেসরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, টিভিইটি সেক্টরে জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো বাস্তবায়ন, গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের আধুনিকীকরণ, বিদ্যমান ৩২টি টিএসসিতে কম্পিউটার ও ইনফরমেশন টেকনোলজি-সিআইটি ট্রেড অন্তর্ভুক্তকরণ এবং অবশিষ্ট বিদ্যমান ৩২টি টিএসসিতে সিআইটি ট্রেডের উন্নয়ন, টিভিইটি সেক্টরে দক্ষতা ম্যাপিং, ৬৪টি জেলায় আরপিএল সেন্টারের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করাসহ বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট একাধিক প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে চলছে সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিন আমার সংবাদকে বলেন, দেশের কারিগরি শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রকল্প শেষ হলে একটা পরিবর্তন আসবে। প্রাথমিকভাবে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ চলছে, আশা করি নির্ধারিত সময়ের মাঝেই এ প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে। প্রকল্প শেষ হলে ষষ্ঠ থেকে শুরু করে একাদশ শ্রেণি অবধি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পিএসসির মাধ্যমে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে। সুতরাং অত্যাধুনিক ও বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন তারা। আমরা আশা করছি, শিক্ষার্থীদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠবে কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি অঙ্গনে একটি ইউনিক ফিচার দাঁড় করাতে সক্ষম হবো। এছাড়া কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষার আওতায় সম্পৃক্ত করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান আমার সংবাদকে বলেন, কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করলে নিজের পাশাপাশি আরও লোকজনের কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়।
এ বিষয়ে পড়লে চাকরি খুঁজতে হবে না। নিজে স্বাবলম্বী হতে চাইলে, ল্যাব অথবা ওয়ার্কশপ দেয়া যায়। তৈরি করা যায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার উন্নতির পেছনে রয়েছে এই কারিগরি শিক্ষা। জার্মানি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার শতকরা ৬৬ ভাগ, সিঙ্গাপুরে ৬৫, জাপানে ৬০, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪০ এবং মালয়েশিয়ায় ২৫ ভাগ। তাই এই শিক্ষা শুধু ব্যক্তি কিংবা পরিবারের নয়, দেশ ও জাতির উন্নতি করবে। আমরা আলপিন পর্যন্ত তৈরি করতে পারি না, সেপটিপিন তৈরি করতে পারি না, স্ক্রু তৈরি করতে পারি না। অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়, এটা উন্নয়ন সহায়ক নয়। আমাদের প্রয়োজন দক্ষ কারিগর। সবার নামধারী বিএ, এমএ পাস করার দরকার নেই। কারণ সব সার্টিফিকেটধারীকে চাকরি দেয়ার সুযোগ আমাদের এই দেশে নেই এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলে বিদেশেও চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে।
সুতরাং শুধু সার্টিফিকেট নির্ভর না হয়ে আমাদের তরুণদের উৎপাদনশীল কাজে জোর দিতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি কারিগরি শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর।