জুলাই ৩, ২০২২, ০৪:৫৩ পিএম
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির ব্যবহার সুফল বয়ে আনলেও বর্তমানে এর নেতিবাচক ব্যবহার অনেকটাই শোচনীয়। অভিভাবকদের অনেকে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিচ্ছেন। এতে করে তারা পড়াশোনার চেয়ে প্রযুক্তির অপব্যবহারের দিকেই বেশি ঝুঁকছে বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।
তারা বলছেন, গত দুই বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে মোবাইল ফোন ও গেজেটের প্রতি আসক্তি। এরফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক এসব শিক্ষার্থী অনেক কিছু না বুঝেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল কন্টেন্ট, স্ট্যাটাস আপলোড করে থাকে। অনেক সময় এর বিরূপ প্রভাবে শিক্ষকরা অপদস্ত হচ্ছেন, কেউ কেউ হত্যার শিকার হচ্ছেন।
শিক্ষার্থীরা যদি এভাবে মোবাইল ফোনে আসক্ত হতে থাকে। তবে আমাদের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। এরথেকে উত্তরণে এখনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। সম্প্রতি নড়াইলে কলেজের অধ্যক্ষকে সাম্প্রদায়িক ঘটনার গুজবে অপদস্ত করায় কঠোর হয়েছে জেলার শিক্ষা প্রশাসন।
ইতোমধ্যে জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত ২৮ জুন জেলা শিক্ষা অফিসার এস এম ছায়েদুর রহমান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের লিখিত এ নির্দেশনা দেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন আনা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা গোপনে মোবাইল আনছে এবং ভালো-মন্দ বিবেচনা না করে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত পোস্ট, লাইক ও শেয়ার নিয়ে বিব্রতকর এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
ইতোমধ্যে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ও মির্জাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী এ ধরনের একটি করে পোস্ট নিয়ে চরম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
এরফলে প্রতিষ্ঠান দুটি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে। এমতাবস্থায়, সুধী সমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারের বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, তাদের সন্তান স্কুল থেকে এসে বাইরের খেলাধুলার চেয়ে স্মার্ট নিয়ে সময় কাটাতেই বেশি জেদ করে।
তারা বলছেন, সন্তানদের ফোন না দিতে চাইলে মাঝে মধ্যে এমন আচরণ করে তাতে অনেক পরিবারেই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে। বর্তমানে অনেক পরিবারই আছে চরম অসহনীয় এক পরিস্থিতিতে, তারা না পারছেন সইতে না পারছেন সন্তাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের যে সামজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের যে চর্চটা তা হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর সার্বিক প্রতিফলন প্রযুক্তি অপব্যবহারেই ঘটছে। মোবাইলের যে আসক্তি এটা কিন্তু হঠাৎ করেই ঘটেনি। ধীরে ধীরে এই কাজটা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি আমরা তো উৎপাদন করি না। আমার শুধু ব্যবহার করি। এই প্রযুক্তিটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটাও আমরা জানি না।’
উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘যে ছুরি ডাক্তার ব্যবহার করে সেটা যদি কসাই ব্যবহার করে, তাহলে নিজের মতো না পারবে সে কোনো কাজ করতে না পারবে মানুষের উপকার করতে। আমরা তো এখন সে অবস্থায় উপনীত হয়েছি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে পড়াশোনাটা ভালোভাবে শেখাতে হয়। একটা শুদ্ধতার চর্চা করতে হয়। প্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটার তো ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে। একটা মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে গেলো আর সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এই মোবাইল ফোন যে কত ভালো কাজে লাগানো যায়, সেগুলো না করে নোংরা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা তো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, আমাদের সংস্কৃতি ওই দিকেই যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সামজিক মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে, মানুষে মানুষের মধ্যে যে বিশ্বাস, ভালোবাসা ছিল তা হারিয়ে গেছে। এগুলো পুনরুদ্ধার করা খুব সহজ কথা নয়।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার ভেতরে আমরা সেই সংস্কৃতিটা দিতে পারিনি। যে সংস্কৃতি এ বিষয়গুলোকে প্রতিহত করত। আমরা তা কখনো শিখাইনি। এটাই অবধারতি। সামনে আরও খারাপ আবস্থা বিরাজ করছে।’
উল্লেখ্য, গত ১৭ জুন নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্র ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলে। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পুলিশে খবর দেন।
এরই মধ্যে ‘অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। পুলিশ গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদেরও সংঘর্ষ বাধে। সে সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা স্বপন কুমারের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। তখন পুলিশ ওই ছাত্রের সাথে অধ্যক্ষকেও থানায় নিয়ে যায়।
তবে অধ্যক্ষকে আটক করা হয়নি বলে জানান নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর। এ ঘটনায় সোমবার দুপুরে মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শেখ মোরছালিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করে নড়াইল থানায় মামলা করেন। মামলার পর সোমবার রাতে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আটক ব্যক্তিরা হলেন মির্জাপুরের সৈয়দ রিমন আলী, মির্জাপুর বাজারের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী শাওন খান ও মধ্যপাড়ার মো. মনিরুল ইসলাম।
এদিকে এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন ৩০ জুন দেয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ২ জুলাই থেকে নির্ধারণ করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিমেস্ট্রট মো. জুবায়ের হোসেন চৌধুরী। অপরদিকে নড়াইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত জেলা পুলিশের তদন্ত টিমের প্রতিবেদনও ২ জুলাই নির্ধারণ করেছে।