Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

প্রক্সি সংস্কৃতির শেষ কোথায়

মুছা মল্লিক

আগস্ট ২, ২০২২, ০১:৫১ এএম


প্রক্সি সংস্কৃতির শেষ কোথায়

সমপ্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে আটক হন ডা. সমীর রায় নামে এক চিকিৎসক। তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং খুলনার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক।

গত ৫ জুলাই পঞ্চগড়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির সাথে সম্পৃক্ততার প্রমাণে মোকসেদুর রহমান, আহসান হাবিব ও বেলাল উদ্দীন নামে তিন যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তিস্তা ব্যাটালিয়ন-২ (৬১ বিজিবি) পরিচালিত নিয়োগ পরীক্ষায় মোহাম্মদ মিজানুর রহমান নামে এক ভুয়া পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তি সারওয়ার মণ্ডল সজীব নামের এক পরীক্ষার্থীর হয়ে কেন্দ্রে আসেন।

বডি চেঞ্জ করেও অর্থাৎ একজনের প্রবেশপত্রে অন্যজন পরীক্ষায় অংশ নেয়ার এমন উদাহরণ শুধু ডা. সমীর রায়, মোকসেদুর রহমান অথবা মিজানুর রহমানই নয়— অনুসন্ধান বলছে, পর্দার আড়ালে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন এমন অসংখ্য সমীর রায় ও মিজানুর রহমানরা। আড়ালে রয়ে গেছে তাদের চক্রের হোতারাও।

বডি চেঞ্জ চক্রের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি চাকরির পরীক্ষা হোক অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি; সবখানেই সরব তারা। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমেই চলে চাহিদামাফিক লোক বাছাই। এরপর চাকরির পদ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী দেনদরবার শেষ হয় মোটা অঙ্কের টাকায়। ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ লাখ অবধি চুক্তির এসব টাকা এককালীন অথবা ধাপে ধাপে লেনদেন হয়। এমসিকিউ, লিখিত এমনকি ভাইভাতেও চলে এমন প্রক্সি সংস্কৃতি।

আইনের ভাষায় প্রক্সি বলতে কোনো অপরাধের নাম নেই। আইনে প্রক্সির নাম দেয়া হয়েছে— পারসোনেশন। কারণ প্রক্সির চেয়ে এর কাভারেজ আরো ব্যাপক। সরকারি পরীক্ষা (অপরাধ) আইন-১৯৮০-এর ৩ ধারা মতে কথিত প্রক্সির সংজ্ঞা হচ্ছে— পরীক্ষার্থী না হইয়াও যিনি সরকারি পরীক্ষার সময় নিজেকে একজন পরীক্ষার্থী হিসেবে ঘোষণা বা বিবেচনা করে পরীক্ষা হলে প্রবেশ করেন।

আইন অনুযায়ী, কেউ যদি অন্য কোনো ব্যক্তির নামে বা কাল্পনিক নামে সরকারি যেকোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, তাহলে তার শাস্তি হবে পাঁচ বছরমেয়াদি জেল। আবার আইনে এটিও নির্দিষ্ট আছে যে, এই শাস্তি কোনোভাবেই এক বছরের কম হবে না।

অর্থাৎ, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ যতই নগণ্য হোক আদালত তাকে এক বছরের কম সাজা দিতে পারবে না। অপরদিকে কেউ যদি প্রক্সি দিতে গিয়ে সরকারি পরীক্ষা সম্পর্কিত কোনো ডকুমেন্ট, এডমিট, নম্বর, নম্বর ফর্দ, টেবুলেশন শিট, সার্টিফিকেট বা যেকোনো প্রকারের পরিবর্তন করেন এবং ধরা পড়েন তাহলে তার জন্য রয়েছে চার বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড, অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কঠোর আইন থাকার পরেও আইনের শাসন নিশ্চিত না করা এবং একই সাথে নৈতিকতার অবক্ষয়ে এ অপরাধ ক্রমশ বাড়ছেই।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘বডি চেঞ্জ করে পরীক্ষা দেয়ার এমন ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। চাকরির পরীক্ষা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় এমন ঘটনা প্রায় দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সতর্ক থাকার পরও এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়াটা হতাশাজনক।

তবে আশার কথা হলো— প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। বডি চেঞ্জ করে পরীক্ষা দিলেও তারা কিন্তু কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে ধরা পড়ছে। 
অপরাধীদের বিরুদ্ধে যখন অন্যরা সতর্ক থাকে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় তখন সমাজ থেকে অপরাধীদের সংখাও কমে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত না থাকুক এমন প্রত্যাশা থাকবে। বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে যারা এমন অনৈতিক কাজ করছে তাদের শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া গেলে এ সমস্যা কমে আসবে।’

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধ সমাজের একটি ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের বিষয়। এখানে অর্থনৈতিক বিষয়ও সম্পর্কযুক্ত। সমাজে এ অপরাধের একটি দাবি আছে বলেই এক ধরনের অসাধু লোক তা সাপ্লাই করছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না, তদন্তও হয় না; ফলে অপরাধীরা ধরা পড়ে না। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে এ ধরনের অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারলে মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার হবে এবং অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া আমাদের দেশের চলমান সংস্কৃতি।

অপরাধের যদি বিচার হয় এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে সমাজে অপরাধ কমে আসবেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেক সময় বিচারকরাও অসহায় বোধ করেন।  অপরাধীদের পেছনে থাকা ক্ষমতাসীন দলের নানান প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ থাকায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

অনেক সময় দেখা গেছে, পুলিশের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অপরাধীদের ধরতে পারছে না। সুতরাং অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার এই সংস্কৃতির কারণেই অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এটিই সরল অঙ্ক।’

তিনি বলেন, ‘একসময় পরীক্ষার হলে নকল সাপ্লাই করা হতো। স্কুলের পেছনে মই দিয়েও নকল সাপ্লাই হয়েছে এ দেশে। সময়ের পরিবর্তনে এখন প্রক্সি দেয়াকেই আরও সহজ মনে করছে অপরাধীরা; ফলে অনেকেই এ পথে হাঁটছেন। সমাজে বিদ্যমান অনৈতিক এসব চাহিদার বিভিন্ন প্রকার হয়। একই সাথে এগুলোর জোগানও হয়। সমাজে অনৈতিক চর্চার একটি বাজার সৃষ্টি হয়ে গেলে তখন আর কিছুই করার থাকে না।

তবে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আইনের শাসন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনীতিবিদরা যেমন বলেন— অপরাধীরা যে দলেরই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে; এগুলো আসলে লিপ সার্ভিস। অপরাধী নিজের দলের হলে সেখানে নানা কৌশলে পার করিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু বিপরীত দলের হলে খুব দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। প্রতিটি সরকারের সময় এই একই চিত্র দেখা যায়। সুতরাং অপরাধী যে দলেরই হোক তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে।

Link copied!