আগস্ট ২৬, ২০২২, ০৬:৩২ পিএম
# পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩০ জন
# কমিউনিটি ভিত্তিক সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
# পানিতে ডোবা বিশ্বব্যাপী আকস্মিক মৃত্যুর তৃতীয় বৃহত্তম কারণ
গত ২১ আগস্ট গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পৃথক স্থানে পানিতে পড়ে ছবুরন নেছা ও মাইশা খাতুন নামে দুই জনের মৃত্যু হয়। গত ২০ আগস্ট দুপুরে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে পানিতে ডুবে জিহাদ হাসান নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। ১৮ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে পুকুরের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। এমন ঘটনা শুধু গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর অথবা লক্ষ্মীপুরের রায়পুরেই নয়।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন পানিতে ডুবে ৩০ থেকে ৫০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। তার মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ শুধু পানিতে ডুবেই মৃত্যুবরণ করছে। সারাদেশে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিশুর সাঁতার শেখানোর প্রকল্পে ২৭১ কোটি ৬১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু সেখানে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর এই নীরব মহামারীতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও তা যথার্থ বাস্তবায়নে অনিয়ম ও সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাবে উদ্বেগ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে কমিউনিটি ভিত্তিক সচেতনতা জরুরী। বাংলাদেশে যেহেতু অনেক জলাভূমি আছে সেহেতু পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বাড়ির নিকটবর্তী পুকুর বেড়া না দিয়ে রাখা, অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার অপ্রতুলতা, ঢাকনাবিহীন কিংবা অরক্ষিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জলাধার পারাপারের অব্যবস্থাপনা, পানি সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি সম্পর্কে অসচেতনতা, পানির আশেপাশে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ যেমন একা একা সাঁতার কাটা, নৌ পথে চলাচল বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান ব্যবহার ও নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রী বহন, অতিরিক্ত ঝড়-বৃষ্টি, সুনামি কিংবা জলোচ্ছ্বাসের কারণে পানিতে পড়ে মৃত্যু নীরব মহামারীতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সরকারি যে বরাদ্দ রয়েছে তার যথার্থ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর পৃথিবীতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়, যাদের ২০ শতাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম। এজন্যই বিশ্বজুড়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে নীরব মহামারি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশে এক থেকে চার বছর বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের জন্য দায়ী পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। এ কারণে বিশ্বব্যাপী পানিতে ডোবাকে আকস্মিক মৃত্যুর তৃতীয় বৃহত্তম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যুকে শিশু এবং তরুণ বয়সের মৃত্যুর প্রধান ১০টি কারণের মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করে। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা পানিতে ডুবে মৃত্যুর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে যেখানে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর আশঙ্কা দ্বিগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে বছরে ২ লাখ ৩৬ হাজার জন মানুষ পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়, যার ৯০ শতাংশ ঘটে নি¤œ এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায় বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার জন মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ৪২ জন এবং প্রতি ৮০ সেকেন্ডে একজন
মৃত্যুবরণ করে।
গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টির এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ মাসে, সারা বাংলাদেশে ৪৬৭টি ঘটনায় ৮৩৩ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদের মধ্যে ৬৮৬ জনই (৮২.৩৫ শতাংশ) শিশু। মৃতদের মধ্যে ২৮১ জন কন্যাশিশু। আর ১৮ বছর বয়সের ওপরে আছেন ৫৪ জন। মারা যাওয়া শিশুর মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী ৩০০ জন, ৫ থেকে ৯ বছরের ২০৭ জন, ১০ থেকে ১৪ বছরের ৬৩ জন এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ২৬ জন শিশু রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে জুন মাসে ১৪৩ জন। সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় আছে মে মাস। এ মাসে মারা গেছেন ১২৮ জন।
পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা সুপারিশ করে আসছে, সেগুলোর মাঝে- মা-বাবাসহ শিশুর অভিভাবকদের পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সচেতন হওয়া, এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশুযত্ন কেন্দ্রে পাঠানো, ছয় বছর হলেই শিশুদের সাঁতার শেখানোর পাশাপাশি সমবয়সী কেউ পানিতে ডুবে গেলে উদ্ধারকৌশল শেখানো, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে সিপিআর (মুখে শ্বাস-বুকে চাপ) প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একইসাথে মৃত্যুর নথিতে কারণ হিসেবে পানিতে ডুবে মৃত্যু উল্লেখ করাসহ জাতীয় তথ্যভান্ডারে তা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশন (এনএডিপি) এর আহ্বায়ক সদরুল হাসান মজুমদার আমার সংবাদকে জানান, শিশুকে যদি সাঁতার শেখানো যায় তাহলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি ৯০ শতাংশ কমে যায়। তবে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশে এখনো বিস্তারিত স্টাডি নেই। সুতরাং তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহের সরকারি উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে। একইসাথে ব্যাপক জনসচেতনা সৃষ্টি করতে না পারলেও এসব তথ্য দিয়ে বিদ্যমান সমস্যা থেকে বের আসা সম্ভব হবেনা। এছাড়া সরকার শিশুদের সাঁতার শেখাতে যে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করেছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, সাঁতার একটি বাচ্চার গুরুত্বপূর্ণ জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা। ছয় বছর হলেই একটি শিশুকে সাঁতার শিখিয়ে ফেলতে হবে। এটা বলতে গেলেই সামনে আসে যে- শহরগুলতে সাঁতার শেখার যথেষ্ট পুকুর নেই, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এগুলো বলতে পারলেও ক্ষতিগুলো কিন্তু পৃথক ভাবেই হয়; সামগ্রিকভাবে না। সুতরাং এসব সীমাবদ্ধতার মাঝেও অনেকগুলো পথ রয়েছে শিশুদের সাঁতার শেখানোর। সেগুলো কাজে লাগাতে হবে।