Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

ভাঙছে না বিএনপি-জামায়াত সংসার

আবদুর রহিম

আগস্ট ৩০, ২০২২, ০৩:০১ এএম


ভাঙছে না বিএনপি-জামায়াত সংসার

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই বিএনপি-জামায়াতের সংসার ভাঙছে না। বিএনপির তিন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জামায়াতের দু’জন নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য আমার সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দেশের রাজনীতিতে চোখ রাখা বিশিষ্টজনরা বলছেন, সময়ে  বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় জামায়াতে ইসলামী। ভোটের রাজনৈতিক পলিসি বুঝতে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ভালো খেলোয়াড। প্রয়োজনে জামায়াত আওয়ামী লীগের সংসারেও যায়, আবার বিএনপির ঘরেও। লাভের হিসাব হলে জাতীয় পার্টির দরবারেও দলটি যাতায়াত করে।

এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ থেকে পর্দার আড়ালে কোনো অফার ফেলে শেষবেলায়ও চলে যেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

দলের চলমান আমির ডা. শফিকুর রহমান ঘরোয়া একটি প্রোগ্রামে নেতাকর্মীদের জানিয়েছেন, বিএনপির সাথে দূরত্ব হয়েছে, কিছু একটা ঘটেছে বলে যেন মনে করা হয়, বিএপিতে থেকে জামায়াতের কোনো লাভ হচ্ছে না। সিক্রেট ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির সাথে জামায়াতের সমঝোতা হয়ে যায়। তারা আপাতত এখনই বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করবে না। বিএনপির হাইকমান্ডও এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।

নীরবতায় সমঝোতায় ঘরের ঝামেলা মেটানো হবে। হিসাব না মিললে ভোটের আগে কিছু ঘটতে পারে। এখন জোট ভেঙে গেলে আওয়ামী লীগের ঘরে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বড় ফায়দা চলে যাবে। চলমান সরকারের বিদায়ের বিষয়ে দু’দল ঐকমত্যে। এমন কোনো কাণ্ড আপাতত করবে না যাতে আওয়ামী লীগ খুশি হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের ঘরে উচ্ছ্বাস চলছে।

জামায়াতের শীর্ষ কয়েকজন নেতা আমার সংবাদকে জানান, দলের আমির যে বক্তব্যে দিয়েছেন তা ব্যক্তিগত। ঘরোয়া আলোচনা মাত্র। ওই আলোচনা কোনো দল ছাড়ার ঘোষণা নয়। জামায়াত এখনো বিএনপির সাথে আছে এবং যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পরিবর্তন চায়। বিএনপির তিন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাথে কথা হয় আমার সংবাদের। তাদের বড় অংশই জামায়াতের বক্তব্যের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

তারা বলছেন, অস্পষ্ট, ঘরোয়া কথার মধ্যে বিএনপির কোনো বক্তব্য নেই। সরকার পতনের আন্দোলনে জামায়াত বিএনপির সাথেই থাকবে। জোটের সাথেই থাকবে। জোট ছাড়ার মতো বড় ভুল জামায়াত করবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ খুশি হতে পারে কিংবা ফায়দা নেবে এমন কাজ জামায়াতে ইসলামী করবে না। জামায়াতের গুরুত্ব বিএনপিতে রয়েছে। খালেদা জিয়ার গড়া ঐক্য ফাটলে কোনোভাবেই তার অনুপস্থিতে আঘাতের পথ বেছে নেবে না কেউই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির সংসারেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এখন যদি জামায়াত হঠাৎ বের হয়ে যায় তাহলে সরকার লাভবান হবে। কিংবা জামায়াত যদি কয়েকটি আসনের ইঙ্গিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কিংবা অন্য কোনো দল নিয়ে ঐক্য গঠন করে তাহলে নির্বাচনের আগে জামায়াতকে কোনো কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হবে না। একটি অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্যতার নির্বাচনের ফসল আওয়ামী লীগ ঘরে তুলে নেবে। পিছিয়ে যাবে বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছে, বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিতেও আছে, আবার জামায়াতকে নিয়েও রাজনীতিও আছে। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হলেও জামায়াত হারিয়ে যায়নি। পাকিস্তান সময় থেকে দেশ বিরোধিতায় জামায়াতের নামটি দেশের কলঙ্কের সাথে যুক্ত। লাভের হিসাব এলেই দলটি দিমুখী অবস্থান নেয়। আবার দলটিকে নিয়েই ভোটের কিছু হিসাব হয়। বাংলাদেশে অন্তত অর্ধশত আসনে লড়াইয়ের মতো সক্ষমতা আছে দলটির। স্বচ্ছ নির্বাচন হলে রাজনৈতিক সমঝোতায় বেরিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন। জামায়াত নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগ মুহূর্তে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। জিয়া গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। সেই থেকে জামায়াত বিএনপির একটি সখ্য আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির প্রতি এখনই জামায়াত এত বড় অকৃতজ্ঞ হবে— ধারণা করা যাচ্ছে না। দুটো মন্ত্রণালয় পাওয়া, বেশ কয়েকটি আসন পাওয়ার পেছনে বিএনপির অবদান রয়েছে। বিএনপি ব্যতীত জামায়াত কোনো আসন থেকে উঠে আসা অনেক কঠিন হবে। আবার উত্তরবঙ্গের কিছু আসন রয়েছে সেখানে বিএনপিকেও উঠে আসতে জামায়াতকে প্রয়োজন।এমন প্রায় ৫০টি আসন আছে— জিততে হলে উভয় দলের সমন্বয় প্রয়োজন। কেউ কাউকে ছেড়ে দিয়ে ভালো থাকা সম্ভব হবে না।

ইতোমধ্যে জামায়াত নেতারা বলছেন, আমীরের ঘরোয়া বক্তব্যে জাতীয় ঘোষণা হতে পারে না। তারা জোটেই আছেন। আবার বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভাষ্য, হাইকমান্ড থেকে আপাতত জামায়াত নিয়ে মন্তব্য করতে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাৎক্ষণিক যে কয়েকজন নেতা খুশি হয়ে মন্তব্য করেছেন তারাও এখন চুপ হয়ে গেছেন।

রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতির বড় চরিত্র ডিগবাজির অংশ। আওয়ামী লীগ সবসময় ভোটের হিসাবে ফাঁকা। আবার জনসমর্থন কম থাকলেও জামায়াতও ভোটের হিসাবে ভালো খেলে থাকে। সময়ের আলোকে ধর্মীয় আদর্শকেও বিক্রি করে দেয়। আস্থা ও বিশ্বাস রাজনৈতিক চরিত্র নিলামে তুলে। নব্বই দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত সংসদে এবং রাজপথে বিএনপির বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। ’

৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ দূরে ঠেলে দেয় জামায়াতকে। এরপর ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সাথে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়ে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়।

২০১৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির সময়ে জামায়াতের একটি অংশ থেকে সরকারের সাথে সমঝোতার দাবি তোলা হয়। যাতে দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা মুক্তি পায়। কিন্তু জামায়াতের একটি অংশ তখন সরকারের সাথে বসতে রাজি হয়নি। সরকারের দরবারে গিয়ে নতি স্বীকার না করতে মজবুত অবস্থানে ছিল।  

একে একে শীর্ষ নেতাদের হারোনার পর ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর জামায়াতের ওই অংশটি সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাথে বৈঠক করে ডোন্ট ডিস্টার্ব নীতি গ্রহণ করে। যারা আগে সরকারের সাথে বসতে রাজি ছিল না।

এমন রাগ ও ক্ষোভে জামায়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাক দল ছেড়ে দেন। আরো অনেকে আড়াল হয়ে যান। মনে কষ্ট থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেননি। তবে বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান ইসলামী আন্দোলনের সাথে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভোটের পলিসির নেতারা এক সাথে কেন আটক হলেন— তাদের বাইরে রেখে বড় বড় সিদ্ধান্তের জন্য দলের ভেতরে অনেক ঝড় উঠছে।  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন আলোচনা চলছে ঠিক তখনই জামায়াতের আমির বিএনপির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। ডা. শফিকুর রহমান এক ঘরোয়া বৈঠকে কর্মীদের বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সাথে থেকে কোনো ফায়দা হাসিল হচ্ছে না।

এরপর বিএনপির একটি অংশ খুশি হয়ে যায়। যারা বিএনপিতে জামায়াতের বিকল্প হিসেবে অন্য দলকে স্থান দিতে চায়। কোনো কারণে জামায়াত চলে গেলেও বিএনপির একাংশ চিন্তিত হচ্ছে না। ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে পার্টিসহ কয়েকটি দলটি বিএনপিতে যুক্ত করার চিন্তা করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বিএনপি জোটের সাথে আছে, জোট ছাড়েনি। জোটের যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য সেটি ঠিক আছে। ঘরোয়া আলাপ কোনোভাবেই দলীয় সদ্ধান্ত বা ঘোষণা হতে পারে না।’

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াতের আমিরও কোনো জোট ছাড়ার ঘোষণা দেননি। তিনি জোটের গঠনমূলক কথা বলেছেন। আমরা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছি, ঘরের কথা কখনোই জাতীয় ঘোষণা হতে পারে না। আশা করি, আপনারা সেটি বুঝতে পারছেন।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেখুন, জামায়াতে ইসলামী তারা ঘরোয়া কী আলোচনা করেছে সে বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। তারা যদি চূড়ান্ত কোনো ঘোষণা দেয় তখন এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। অস্পষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়।’

বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘তারা জোট ছেড়েছে কি-না এ নিয়ে অ্যাডভান্সড কিছু বলা যাবে না। তারা এখনো কোনো ঘোষণা দেয়নি। হ্যাঁ, কিন্তু, যদি মনে করেন— ইত্যাদি শব্দ ঘোষণা হতে পারে না। জামায়াত বিএনপি জোটে আছে আমরা এটাই জানি।’

বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামায়াত ঘরোয়া যে কথা বলেছে এটি ঘোষণা নয়। এ নিয়ে কথা বলা বা মন্তব্য করা যায় না। এটি একটি অস্পষ্ট বিষয়।’

Link copied!