আগস্ট ৩১, ২০২২, ০৯:৪৪ এএম
শামসুল ইসলাম বাবুল। চট্টগ্রাম নগরের মিসকিন শাহ মসজিদের আশপাশ এলাকায় ২০ বছর ধরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রির কাজ করেন। প্রতি মাসে তিনি অন্তত ৩০টি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেন। সে হিসাবে গত ২০ বছরে সাত হাজারের বেশি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেছেন। তবে চট্টগ্রাম মহানগরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীদের তালিকায় শামসুল ইসলাম বাবুল নামে কারো নাম নেই।
তাকে কি, কাজী হিসেবে প্রায় দুই যুগ কাজ চালিয়ে আসছেন বাবুল। মাজার এলাকার রাশেদুল বারি নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রতি শুক্রবার মাজারে তিন থেকে চারটি বিয়ে হয়। বেশিরভাগ বিয়ে হয় আসরের নামাজের পর। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনও কম-বেশি বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন হয়। সবগুলো বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করেন বাবুল।
অন্যান্য কাজীদের চেয়ে তিনি অর্ধেক টাকা কম রাখেন। ভুয়া কাজী নিয়ে ঢাকা শহর ও আশপাশের থানাগুলোতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান কাজী। যাদের আইনগত বিয়ে পড়ানোর এখতিয়ার নেই। কাজী হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধিবিধান রয়েছে তার কোনোটাই তাদের নেই। এর অধিকাংশই ঢাকা জজকোর্ট এলাকায়। কিছু অসাধু আইনজীবী ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ ওই ভুয়া কাজীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এছাড়া ঢাকার আশপাশের থানাগুলোর অলিগলিতে কাজী আছে, অফিসও আছে, নিয়মিত বিয়েও পড়াচ্ছেন। আছে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার, সরকার নির্ধারিত বালাম বইও। তবে সেটা ভুয়া। তাদের নেই আইনগত কোনো বৈধতাও। সেই সাথে কাজীর নেই সরকারি নিবন্ধনও। তবুও কথিত কাজী পরিচয়েই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করছেন বছরের পর বছর। শুধু পাড়া-মহল্লায় নয়, কোর্ট চত্বরেও চলছে ভুয়া জন্মসনদ, নকল কাবিননামা আর জাল সিল-স্বাক্ষরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি। জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এসব নামসর্বস্ব কাজীর ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
আসল ভেবে ভুয়া কাবিননামা, তালাকনামা দাখিল করে সম্পত্তির অধিকার, পিতৃত্ব ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিতের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবুও ভুয়া কাজীদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে গণমাধ্যমে খবর আসলেও প্রতিকার মিলছে। ফলে পাড়া-মহল্লাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কাজী অফিস। বেপরোয়াভাবেই চালাচ্ছেন তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড।
জানা গেছে, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদের কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন এলাকায় কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার তথ্য নেই। তাই সারা দেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কার্যক্রমে। এমন অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ার জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
তাদের মতে, ভুয়া কাজীর দৌরাত্ম্য কমাতে নিকাহ-তালাক নিবন্ধনে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিয়ে ও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তর সুরক্ষায় ডিজিটালাইজড রেজিস্ট্রেশনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে রিটকারি আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, বর্তমান সময়ে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার প্রবণতা বেড়েছে। তথ্য গোপন করে একজন ব্যক্তি একাধিক বিয়ে করছে। তালাকও দিচ্ছে। এটা হওয়ার কারণ বিয়ে ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড না হওয়া। আবার অনেক সময় নিবন্ধনহীন ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি করে অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। বিয়ের বৈধতা না থাকায় পরবর্তীতে তারা আইনগত সুবিধা পাচ্ছে না। তাই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা ও কাজীদের নিবন্ধনের বিষয়টি ডিজিটাল হওয়া সময়ের দাবি। এটা কার্যকর করতে পারলে বিয়েতে প্রতারণার দরজা বন্ধ হবে।
আইনজীবীরা বলছেন, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালাইজেশনের আগে প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রশ্ন রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে বহু প্রকল্প রয়েছে। কোনো একটি প্রকল্পের আওতায় নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। তারপরই ডিজিটাল ব্যবস্থা কার্যকর ফল দেবে। অন্যথায় ডিজিটাল ব্যবস্থার নামে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কেবল হয়রানিই বাড়বে। এদিকে নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রিতে শৃঙ্খলা আনয়নে কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরিসহ ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ ও ভুয়া কাজীরা খুবই শক্তিশালী। তাদের আইনের আওতায় আনা অসম্ভব। কারণ তারা একটি সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে। এতে সারা দেশের ভুয়া কাজীরা জড়িত আছে এবং সব একত্রিত হয়ে অর্থ ঢেলে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে। তাদের বিরুদ্ধে বাল্যবিয়ে, ভুয়া বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রিসহ বেআইনিভাবে বিয়ে পড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেলেও ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এর আগেই তারা আদালতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রিট মামলা করেন। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার অনেক কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে সাত হাজার ৯০০ জন কাজী রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় রয়েছেন ২৩১ জন। শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে এলাকায় রয়েছেন ১২৯ জন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই তালিকার বাইরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সব কাজী রয়েছেন তারা অবৈধ। এ সংখ্যা প্রায় চারশ। তাদের কোনো নিবন্ধনপত্র নেই। রাজধানীতে কয়েকটি এলাকা বড় হওয়ায় সেখানে একের অধিক কাজী রয়েছেন। ঢাকা জজকোর্ট, রামপুরা, বসুন্ধরা, মগবাজার, মালিবাগ, মহাখালী, উত্তরা, ফার্মগেট, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছেন অগণিত ভাসমান কাজী। তাদের কোনো বৈধ সনদ বা ঠিকানা নেই।
ভুয়া কাজীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘অবৈধ ও ভুয়া বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধনের দায়ে ওই কাজির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দণ্ডবিধিতে আছে। দণ্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুযায়ী কাজির এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। নিবন্ধিত না হয়েও বৈধ কাজীর রূপ ধারণ করে কাজ করা প্রতারণার সামিল। অপরদিকে মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব দুই বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময় ভুয়া কাজী ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু তাদের শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। ভুয়া কাজীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
বিদ্যমান নিকাহ ও তালাক ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করা উচিত কিনা— এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু ধীরে ধীরে সবকিছু ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে, তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিকাহ সিস্টেমটাকে আধুনিক করা এখন সময়ের দাবি।
কাজীর তালিকা ও ভুয়া কাজীর শাস্তি না হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, এটা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা। অবিলম্বে মন্ত্রণালয়কে বিয়ে নিবন্ধক (কাজীদের) তালিকা, এরিয়ার তালিকা তৈরি করে অনলাইনে দিয়ে দেয়া দরকার। সদিচ্ছা থাকলে এই কাজটি এক মাসেই সম্ভব এবং তালিকার কপি, উপজেলা প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান এবং থানায়ও দিয়ে দেয়া যায়। খুব সাধারণ কাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় এমন জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ উপেক্ষিত হয়ে আছে, এটা দুঃখজনক।
বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব কাজী মাওলানা মো. খলিলুর রহমান সরদার বলেন, ‘বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর-কনের অনেক তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। রেজিস্ট্রি পদ্ধতি এখনো এনালগ রয়ে গেছে। ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা গেলে ভুয়া কাজী সনাক্ত করা সহজ হতো। বৈবাহিক তথ্যের ডাটাবেজ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যেত। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রান্তিক জনপদের অধিক্ষেত্রগুলোতে অনেক বয়স্ক নিকাহ রেজিস্ট্রার রয়েছে। তাদের অনেকেরই তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। ল্যাপটপ তো দূরে থাক, টাচ মোবাইলই ব্যবহার করতে পারেন না তারা।