সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২, ১২:৪২ এএম
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে চলছে নিয়ন্ত্রণ বা কার ক্ষমতা বেশি, এমন মহড়া। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুরপর অদ্যাবধি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভুগছে। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ভাই জিএম কাদের মধ্যে চলছে ক্ষমতার চেয়ার ধরে রাখার লড়াই।
অর্থাৎ ভাবি আর দেবরের রাজনৈতিক রসায়ন। দলটির দুই নেতাই নিজেদের সংগঠনের একমাত্র নিয়ন্ত্রক বলে দাবি করছেন। যখন তখনই দলের ভেতরে পদোন্নতি, বহিষ্কার, পদ দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হরহামেশাই বিবৃতি, নোটিস দিচ্ছেন একে অপরকে। যা নিয়ে দলটির কেন্দ্র হতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।
সর্বশেষ গত এক মাস ধরে দলটিকে চলছে নানা নাটকীয় ঘটনা। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ এ অসুস্থতার মধ্যেই গত ৩০ আগস্ট জাতীয় পার্টির দশম জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি পাঠালে দলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তাতে রওশন নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক এবং তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহকে সদস্যসচিব করে আট সদস্যের কমিটির ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু কমিটির সদস্যসচিব গোলাম মসীহের জাপায় প্রাথমিক সদস্য পদও নেই।
আর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে যে ছয়জন যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়, তারা জানিয়েছেন এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। এরপর জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরিয়ে উপনেতা জিএম কাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করতে স্পিকারকে চিঠি দেয় জাপার সংসদীয় দল। যদিও সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। এরপর বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরানোর চিঠি প্রত্যাহার চেয়ে স্পিকারের কাছে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙা চিঠি দেন।
এরপর এই চিঠির রেশ ধরেই মসিউরকে সভাপতিমণ্ডলীসহ দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেন জাপার চেয়ারম্যান। মসিউর রহমানকে অব্যাহতি দেয়ার পর গত মঙ্গলবার রংপুর জেলা কমিটি বিলুপ্ত করে ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে জাপা। মসিউর রহমান দীর্ঘদিন রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে তাকে রাখা হয়নি।
সর্বশেষ ২১ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে দলের ফিরিয়ে আনতে জিএম কাদেরকে নির্দেশ দেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। সেখানে বলা হয়, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই চিঠি দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে রওশন উল্লেখ করেন, ‘গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা-১ অনুযায়ী প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ক্ষমতাবলে চেয়ারম্যানের বিশেষ ক্ষমতা এবং মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ধারা ২০-এর উপধারা ১ (১)-এর ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ এবং উপধারা ২-এর ক, খ, গ এবং উপধারা-৩-এ বর্ণিত অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক বিধান স্থগিত করে জাতীয় পার্টির অব্যাহতিপ্রাপ্ত ও কমিটি থেকে বাদ দেয়া সব নেতাকর্মীকে পার্টিতে অন্তর্ভুক্তির আদেশ দেয়া যাচ্ছে।
নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে যে চিঠিটি স্পিকারকে দিয়েছিলাম, সেটি অগঠনতান্ত্রিক ছিল। সে কারণে চিঠিটি প্রত্যাহারের জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন দিয়েছি। বিরোধীদলীয় নেতার পদটি সাংবিধানিক পদ, এই পদ থেকে সরাতে হলে অ্যাজেন্ডা দিয়ে বৈঠক ডাকার কথা। জাতীয় পার্টি তড়িঘড়ি করে পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক করেছে, সেখানে কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল। আমি ওই চিঠি দেয়ার আগেও প্রতিবাদ করেছিলাম, সে কারণে কোনো নোটিস ছাড়াই আমাকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক ধারা-২০ বাতিল না করলে জাতীয় পার্টি করব না।
তিনি বলেন, ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায়, তা নয়। নানা রকম দুর্নীতি হচ্ছে, পদবাণিজ্য হচ্ছে। ২০ ধারার অপব্যবহার করে দলকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এভাবে চললে দলের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। যাতে লুটপাট করে খাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দলটিকে ক্ষমতায় নেয়ার কোনো চেষ্টা তারা করছে না। মনোনয়নবাণিজ্য করা হচ্ছে, কার কাছ থেকে কত টাকা নেয়া হয়েছে আমি দেখিয়ে দিতে পারব।
তিনি বলেন, এ রকম একটি ধারা থাকতে পারে না। এই ধারায় ৪০ জনের মতো নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে এই ধারা বাতিল করা না হলে পার্টি করব না। অন্য কোনো দলেও যাবো না, প্রয়োজনে সংসদ থেকেও পদত্যাগ করতেও প্রস্তুত আছি। কথায় কথায় বহিষ্কার করা হচ্ছে। পার্টি অফিসে অনেককে নির্যাতন করা হচ্ছে। দলকে নিয়ে ব্যবসা করতে দেয়া হবে না। অন্যদিকে, গত বুধবার ছেলে সাদ এরশাদসহ আরও দু-একজনের কাছে রওশন এরশাদ জিম্মি হয়ে পড়েছেন বলে দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মো. মুজিবুল হক।
তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ পার্টির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কিছু করছেন বলে বিশ্বাস করি না। তবে ম্যাডাম তার ছেলে ও আরও দু’-একজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। গতকাল বেগম রওশন এরশাদের যে চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেই চিঠি আমরা আমলেই নিচ্ছি না।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক দাবি করেন, সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা দলের গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার একজন সুবিধাভোগী। এখন গঠনতন্ত্র ও ২০ ধারা নিয়ে তার কথা বলাটা স্ববিরোধিতা।
তিনি বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গঠনতন্ত্রের ২০ ধারা ব্যবহার করে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মসিউর রহমানকে মহাসচিব করেছিলেন। তখন তো তিনি এই ধারার বিরোধিতা করেননি। তিনি গঠনতন্ত্রের ওই ধারার সুবিধাভোগী।
মুজিবুল হক বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় পার্টির সম্মেলনের আগে মসিউর রহমান মহাসচিব ছিলেন। সম্মেলনে গঠনতন্ত্র অনুমোদন প্রক্রিয়ায় তিনি যুক্ত ছিলেন। সম্মেলন-পরবর্তী প্রায় দুই বছর এই গঠনতন্ত্র মেনেই মসিউর রহমান মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কখনোই গঠনতন্ত্রের কোনো ধারার বিরোধিতা বা আপত্তি করেননি।
জাপার মহাসচিব বলেন, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে। দলে কোনো বিভেদ নেই, কোনো ষড়যন্ত্রই দলের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারবে না।