অক্টোবর ৬, ২০২২, ১২:৫৪ এএম
জোটবদ্ধ হয়ে টানা তিনবার ক্ষমতার স্বাদ পেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা। নিবন্ধন তো দূরে থাক, নিজস্ব অফিসও করতে পারেনি সাতটি দল। নামসর্বস্ব কাগুজে দলই রয়ে গেছে দলগুলো। ক্ষমতা ভাগাভাগির দৌড়ে কয়েকটি দল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একাধিক দলের নেই কেন্দ্রীয় কমিটি। ফলে জোটে থাকলেও কাগুজে দলই রয়ে গেছে। নিজেদের ভাগ্য বদলাতে পারলেও দলের চেহারা বদলাতে পারেননি। নেতৃত্বদানকারী দলের মর্জিতেই তারা চলেন।
১৯৯৮ সালে বাম ঘরানার দলগুলো নিয়ে গঠিত হয় ১১ দলীয় জোট। ২০০৪ সালের ১১ দল সাথে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ও জাসদকে সাথে নিয়ে ১৪ দলীয় জোট আত্মপ্রকাশ করে। ১১ দলীয় জোটে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি), গণফোরাম (ড. কামাল), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (খালেকুজ্জামান), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মাহবুব), গণআজাদী লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি। ওই ১১ দলীয় জোটের মধ্যে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাথে আছে সাতটি দল। আর্দশগত দ্বন্দ্ব, নেতৃত্ব নিয়ে মতভেদ থাকার বাকিরা বের হয়ে গেছে অনেক আগেই।
এরমধ্যে ওয়ার্কাস পার্টির একটি অংশ (মেনন), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি (জাকির) অংশ জোটে থাকলেও শক্ত ভিত গড়তে পারেনি। নতুন করে জোটে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন (বিটিএফ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)। বর্তমানে আওয়ামী লীগ জোটভুক্ত দলের সংখ্যা ১২।
এরপরও জোটটি ১৪ দলীয় জোট হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সাথে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) মিলে মহাজোট সরকার গঠন করে। এরপর ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় পার্টি (এরশাদ) বেরিয়ে আলাদা নির্বাচন অংশ নিলেও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেও এখনো কাগুজে দলই রয়ে গেছে সাতটি শরিক দল। দলগুলো হলো— বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণআজাদী লীগ ও তরিকত ফেডারেশন।
গুটিকয়েক নেতাকে ঘিরে পরিচালিত দলগুলো ভেঙে আরও ছোট হয়ে পড়ছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও সুবিধাবাদী প্রবণতার কারণে ছোট ছোট দলগুলো ভেঙে ব্র্যাকেটবন্দী হয়ে পড়ছে। নেতায় নেতায় বিভক্ত হয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ ও সাম্যবাদী দল।
গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও বাসদ কেন্দ্রীয় অফিস তো দূরে থাক পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে পারেনি। ইসিতে নিবন্ধন হওয়ার যোগ্যতার বালাই নেই দল তিনটির। কমিউনিস্ট কেন্দ্র চলছে দুই জনের আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। আর মজদুর পার্টি চালান সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক দুজনই।
এরা আবার দুজন চলেন আলাদা। বাসদ চলছে একটি আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে। নেই কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান দাবি করেন, মাঠের রাজনীতিতে বাসদ এখন অনেক শক্তিশালী। অন্তত ১০টি আসনে শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নেয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি চলছে। আশা রাখি আগামী নির্বাচনের আগেই পাবো।
গণ আজাদী লীগ (একাংশের) সভাপতি অ্যাডভোকেট এস কে সিকদার জানান, গণআজাদী লীগ যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন শক্তিশালী। জোটের কাছে আমাদের কোনো দাবি নেই। আমাদের প্রতিটি নেতাকর্মী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের ছেলের নেতৃত্বাধীন রয়েছে আরেকটি অংশ।
এই অংশের সভাপতি সৈয়দ সামসুল আলম হাসু তর্কবাগীশ জানান, শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন না করায় আমরা জোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। তবে গণআজাদী লীগ ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। আমাদের মহাসচিব আতা উল্লাহ খান সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন।
মজদুর পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী জানান, বর্তমানে দেশে-বিদেশে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্রাইসিস যাচ্ছে, নেতৃত্বাধীন দল (আওয়ামী লীগ) আন্তরিক না হলে জোটের রাজনীতি শক্তিশালী হবে না। আমরা ছোট দল, তাদের মর্জিতেই চলতে হয়। নিবন্ধন থাকলেও গণতন্ত্র পার্টি, সাম্যবাদী দলের দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই। ন্যাপ মাঝে মধ্যে আলোচনা সভার আয়োজন করে অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ক্ষমতার ১৪ বছরে ন্যাপ কেমন আছে জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, জোটের কমিটমেন্ট এখনো পূরণ হয়নি, ক্ষমতার ১৫ বছর, এখন শেষ সময় চলছে। দেখা যাক আওয়ামী লীগ কি করে। আগামী নির্বাচনের আগেই পরিষ্কার হবে।
বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া দৈনিক আমরা সংবাদকে বলেন, সাম্যবাদী দল আগের চেয়ে এখন অনেক শক্তিশালী। আগামী ২৫ অক্টোবর আমাদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন, ওই দিন আসেন দেখতে পারবেন, আমরা কতটা শক্তিশালী। জোটের বড় শরিক দল জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিও চলছে ঢিলেঢালাভাবে। দুটি দলই আছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। জাসদ প্রতিষ্ঠার পর অন্তত পাঁচবার ভাঙনের কবলে পড়েছে।
সর্বশেষ গত ২০১৬ সালে জাসদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি অংশের নেতৃত্বে আছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও শিরীন আখতার। আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান। বিভক্ত হলেও দুই অংশই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের রয়েছে। আম্বিয়া, প্রধান অংশটি ইসিতে নিবন্ধন আবেদন করেছে ২০১৮ সালে, তবে এখনো কোনো সবুজ সংকেত পাননি।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, দলকে সংগঠিত করতে আমরা কাজ করছি। জোটের রাজনীতি যা হওয়ার তাই হবে। এ নিয়ে ভাবছি না, আওয়ামী লীগ ভাবলেই হবে। দলীয় ভিত নড়বড়ে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি। জোটে মূল্যায়ন নিয়ে দলটির সিনিয়র নেতারা (পলিট ব্যুরো সদস্য) মেননের ওপর ক্ষুব্ধ। যা নিয়ে বিভেদ ঘরের মাঠে গড়িয়েছে। ভাঙন হয়েছে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনে। দলটির চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী এবং সাবেক মহাসচিব লায়ন এমএ আউয়াল দুটি বলয়ে চলছে দলটি। তবে এমএ আউয়াল একটি হত্যামামলায় জড়িত হওয়ার পর তার অংশটি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।