Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২৪,

সক্ষমতার কাঠগড়ায় ইসি

আবদুর রহিম

অক্টোবর ১৩, ২০২২, ০১:০৯ এএম


সক্ষমতার কাঠগড়ায় ইসি

ভোটকেন্দ্রে ডাকাত দেখল ইসি। গোপন বুথে ঢুকে শক্তি প্রয়োগ করে দিচ্ছে ভোট। ইসির চোখে এমন দৃশ্যে স্থগিত হয়ে গেলো গাইবান্ধা-৫ আসনে উপ-নির্বাচন। এক হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরা। প্রতি ইউনিয়নে একজন করে মোট ১৭ জন নির্বাহী হাকিম ও দু’জন করে বিচারিক হাকিম দায়িত্বে। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এক হাজার দুই শতাধিক। মাঠে ছিল কয়েক প্লাটুন বিজিবিসহ অন্য বাহিনীর সদস্য। তবুও ভোটডাকাত থেকে কেন্দ্র রক্ষা করতে পারেনি আউয়াল কমিশন।

এরপরই দেশের সুশীল সমাজ, ভোটার ও দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেছে— যে কমিশন একটি মাত্র আসন রক্ষা করতে পারে না, ভোটারদের সুরক্ষা দিতে পারে না; ক্ষমতাসীনদের প্রভাব ও ভোটডাকাত থেকে বুথ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, সেই ইসি একসাথে ৩০০ আসনে কিভাবে নির্বাচন করবে। এই ব্যর্থতার জন্য ইসিকে এখনই পদতাগ করার দাবি তোলা হয়েছে। আর ইসি যদি এই ঝুঁকিতে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে তাহলে তার দায়ভার ইসিকেও নিতে হবে।

তবে কমিশনকে অসহযোগিতা করে সরকার ‘সাংবিধানিক কর্তব্য’ পালনে অভিযুক্ত হয়েছে বলেও দাবি তোলা হচ্ছে। আগামীতে যদি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হয় তাহলে দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক বলে দাবি করা হচ্ছে। অতীতে যতগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে সবগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি নির্বাচন হয়েছে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাই ইসিকে গাইবান্ধার ব্যর্থতায় এখনই পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে।

জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে ভোটারের উপস্থিতিতে ভোট গ্রহণ শুরু হলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে অনিয়মের খবর আসতে থাকায় গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে ইসি।

এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপনির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমরা স্বচক্ষে গোপন কক্ষে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোট দিতে দেখেছি। তাই উপনির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে।’ গতকাল দুপুরে নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে সিসিটিভি ক্যামেরায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার পর প্রেস বিফ্রিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে দফায় দফায় ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়।

সিইসি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছি। ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছি।’

তারাই ভোটকেন্দ্রের ডাকাত কি-না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সিইসি বলেন, ‘এরাই ডাকাত, এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানে না, তাদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি। আমাদের সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নির্বাচন কমিশন এখানে বসে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না। তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে কেন চলে গেল, তা আমরা বলতে পারব না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অনেকটাই। আপনারাও দেখতে পেয়েছেন, গোপন কক্ষে কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে, এখন তা চটজলদি বলতে পারব না।’

সিইসি আরও বলেন, ‘আরপিও ৯১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ভোট নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। কমিশন যদি মনে করে নির্বাচন সঠিকভাবে হচ্ছে না, তাহলে একটি কেন্দ্র বা সব কেন্দ্রে নির্বাচন বন্ধ করার দায়িত্ব কমিশনকে দেয়া হয়েছে। সেই বিধানের আলোকে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।’

অনিয়মের কারণে কয়েক দফায় ৫১টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান সিইসি। নির্বাচন কমিশন মনে করে, ৫১ কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি যে কেন্দ্রগুলো আছে, তার ভিত্তিতে ফলাফল মূল্যায়ন সঠিক হবে না। পরবর্তী সময়ে বিধিবিধান ও আইনকানুন পর্যালোচনা করে কমিশন নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি।

দুপুরের আগেই আ.লীগ ছাড়া চার প্রার্থীর ভোট বর্জন : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মাহমুদ হাসান রিপন ছাড়া বাকি চার প্রার্থী উপ-নির্বাচনের ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তারা। ভোট বর্জনকারী প্রার্থীরা হলেন— জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক)। সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা কেন্দ্রে চার প্রার্থী একত্রিত হয়ে সংবাদকর্মীদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আ.লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেয়া, ইভিএমএ জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ তুলে ভোট বাতিলের দাবি জানান তারা।

এ আসনে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন— আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. মাহমুদ হাসান (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক)।

ইভিএমের মাধ্যমে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে মোট ভোটার ছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার ৯৮ জন। স্থানীয় এক ভোটার জাহাঙ্গীর খান মনে করেন, আমি বাংলাদেশের একজন ভোটার এবং সাধারণ নাগরিক মত প্রকাশ করছি নির্বাচন কেন্দ্রের যে পরিস্থিতি দেখেছি তাতে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কখনো সম্ভব না, সাবেক দুই নির্বাচন কমিশনার যেই সুরে কথা বলেছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনার ঠিক একই সুরে কথা বলছে, তাতে আমি ভোটার বিশ্বাস করিতে পারি না যে, আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশি তাকে দেবো। আবারো দেশের ভোটাধিকার হত্যার পরিকল্পনা চলছে, কারণ সব দলের সমান অধিকারের নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনো পাইনি।

জাহান বিক্রম নামে আরেকজন বলেন, একটি আসনের নির্বাচন যে কমিশন কন্ট্রোল করতে পারে না, সে কমিশন ৩০০ আসনে একযোগে কিভাবে নির্বাচন করবে? এখান থেক শিক্ষা নিয়ে এই নির্বাচন কমিশনের সাথে সাথেই পদত্যাগ করা উচিত ছিল।

নূর নবী মামুন বলেন, একটি আসনের উপ-নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে ৩০০ আসনের কী হবে? আজ না হয় একটি আসনের কারণে সরকার পরিবর্তন হবে না; ৩০০ আসনের সাথে পাঁচ বছরের সরকার ও শাসন জড়িত। ৩০০ আসনে এমন নির্বাচন হচ্ছে, হবে। তাহলে আর ভোটের আয়োজন করে কী লাভ? সরকারকে পাঁচ বছর পর একটা অটো রিনিউয়াল দিয়ে দিলেই তো হয়। এ জন্যই আমরা বলি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই স্বাধীনভাবে ফাংশন করতে পারবে না, যদি না সরকার নিরপেক্ষ হয়।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ‘গাইবান্ধার উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে অসহযোগিতা করে সরকার সাংবিধানিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে। একটিমাত্র উপ-নির্বাচনে ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে কয়েক প্লাটুন রেপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার সদস্য ছাড়াও এক হাজার ২৮৫ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব থাকার পরও নির্বাচনে কারচুপি ফেরানো যায়নি। তাহলে ৩০০ আসনের নির্বাচনে ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সরকার অক্ষম।’

গাইবান্ধার নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমকে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ভোট গ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমরা স্বচক্ষে গোপন কক্ষে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোট দিতে দেখেছি। তাই ভোটকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে।’ এতে প্রমাণ হয়— অতীতের মতো আজ অনুষ্ঠেয় একটিমাত্র উপনির্বাচনেও নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সহযোগিতা করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকার আগের মতো ব্যর্থ হয়েছে।

১২৬-এ বলা হয়েছে—‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’। সরকার গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনে সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য পালন করেনি। সরকার ভোটডাকাতি, ভোট কারচুপি ও জনগণবিহীন ভোটের সংস্কৃতিতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের অসহযোগিতা ও সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ লংঘন করার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া, নতুবা নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ করা। এটিই হবে নির্বাচন কমিশনের নৈতিক কর্তব্য।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমান ইসি একটি আসনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ৩০০ আসনে তারা কীভাবে নির্বাচন করবে। এই ইসির অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। অতীতে দুটো নির্বাচন হয়েছে এক তরফা, যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিন্তু অতীতে চারটি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ওই নির্বাচনগুলোই সুষ্ঠু হয়েছে। আর বাকি যে পাঁচটি নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে, তা ভালোভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থার যে ভঙ্গুর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ জন্য আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনোভাবে অংশগ্রহণমূলক সম্ভব নয়। আর এই ইসিকে এখনই পদত্যাগ করা উচিত। তারা যদি মনে করে, এমন পরিস্থিতির মধ্যে তারা গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে— তাহলে এই ব্যর্থতার দায় ইসিকেও নিতে হবে।’

Link copied!