ডিসেম্বর ৯, ২০২২, ০২:৩৬ পিএম
- লাফিয়ে বাড়ছে কাগজ, ইলেক্ট্রনিক্স পার্টসসহ সব আমদানি পণ্যের দাম
- অফিস-আদালতে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রম
- লোকসানের মুখে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবছেন অনেকে
- এলসি খোলা কমলেও বেড়েছে নিষ্পত্তি, কাটছে না ডলার সংকট
শিক্ষার্থী মিরাজ। ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) একটি কোর্সে স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। কোর্সটি করতে তার একটি কম্পিউটার প্রয়োজন। আইডিবির মডিউল অনুযায়ী বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল একটি ডেক্সটপ কিনতে তার খরচ হবে ৪০ হাজার টাকা। ধারদেনা করে টাকা জোগাড় করতে ১৫ দিন সময় লেগেছে। টাকা নিয়ে রাজধানীর মাল্টিপ্লান সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল প্রতিটি পার্টসের দাম বেড়ে গেছে। ফলে তার পছন্দের ডেক্সটপটির দাম বেড়ে ৪৯ হাজার টাকায় ঠেকেছে। অর্থাৎ দুই সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৯ হাজার টাকা। তাই তাকে অপেক্ষাকৃত কম কনফিগারেশনের পার্টস দিয়ে ডেক্সটপটি কিনতে হয়েছে। ফলে তার কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, ইলেক্ট্রনিক্সের প্রতিটি পণ্য আমদানি নির্ভর হওয়ায় প্রতিদিন দাম বাড়ছে। এমনকি যেসব জিনিসের চাহিদা বেশি সেগুলোর দাম সকালে একরকম তো বিকেলে অন্যরকম। মাল্টিপ্লান সেন্টারে ইলেক্ট্রনিক পণ্য সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন রিপন। কাস্টমারের কাছ থেকে গত বুধবার সকালে একটি ল্যাপটপ সার্ভিসিংয়ের জন্য রেখেছেন। দুপুরের পর পার্টস কিনতে পাশের দোকানে গিয়ে দেখেন আগের দিনের চেয়ে ৫০ টাকা বাড়তি। কাস্টমার তো এটা মানবে না। তাই তার লোকসান গুনে হলেও কাজটি করতে হবে।
আমার সংবাদকে রিপন বলেন, সব জিনিসের দাম বাড়তি থাকায় কাজ খুবই কম। দু-একজন যা আসে, দাম শুনলে চলে যায়। যাদের জরুরি প্রয়োজন কেবল তারাই কাজ করান। আয়-রোজগার খুব কম হওয়ায় সংসার চালাতে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
ইলেক্ট্রনিক্স, কসমেটিক্সসহ সব ধরনের আমদানি পণ্যের ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবার মাঝেই চাপা ক্ষোভ। ক্রেতারা দরকষাকষি করছেন। আর বিক্রেতারা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবছেন। বিকল্প আয়ের সুযোগ না থাকায় লোকসান গুনেই অপেক্ষায় আছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার। কিন্তু পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে তা কারো জানা নেই। শুধু ব্যবসায়ীরাই সমস্যায় আছেন তা কিন্তু নয়। অফিস-আদালতেও বিঘ্নিত হচ্ছে কাজ। সবচেয়ে সংকট কাগজে। হুহু করে দাম বাড়তে থাকায় কাগজে ব্যয় বেড়েছে। বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না মানসম্মত কাগজ।
বিক্রেতারা বলছেন, পাল্প সংকটে দেশীয় ওয়েস্টেজ পেপার দিয়েই তৈরি হচ্ছে কাগজ। তাই মান ঠিক থাকছে না। পাল্প আমদানি ব্যাহত হওয়ায় শিগগিরই মিলছে না সমাধান।
বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসে কম্পিউটারের টোনার, প্রিন্টারসহ পার্টস সরবরাহ ও সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন ব্যবসায়ী সোহেল। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘যেসব অফিসের টেন্ডার নেয়া আছে তারা বারবার ফোন দিচ্ছেন মালামালের জন্য। অনেক অফিসে বিকল হওয়া কম্পিউটার ও ক্যামেরা মেরামত প্রয়োজন। ইঞ্জিনিয়ারের বেতন দিচ্ছি কিন্তু কাজ করতে পারছি না পার্টসের অভাবে। দাম বেশি তাই পোষাচ্ছে না। আবার বেশি দাম দিয়েও মাল পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে হয়ে নিজেই আমদানির সিদ্ধান্ত নেই, ব্যাংকে গিয়ে জানতে পারি আপাতত এলসি বন্ধ। এভাবে চলতে থাকলে কাজ হারিয়ে ফেলব, আবার কাজ করেও লোকসান গুনতে হবে।’
জানা গেছে, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় গত অর্থবছর বড় বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছিল দেশ। এর ফলে ডলারের সংকট তৈরি হয়। তাই ডলার সংকট কাটাতে দেশের আমদানিতে লাগাম টানায় উদ্যোগী হয় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যার ফলে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করেছে ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে কিছুটা ভারসাম্য এলেও হুমকিতে পড়েছে আমদানি-নির্ভর শিল্প ও ব্যবসা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নতুন এলসি খোলা দুই হাজার ৮২৮ কোটি ডলার বা ২৮.২৮ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩৭১ কোটি ডলার বা ৩৩.৭১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৪৩ কোটি ডলার বা ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
তবে নতুন এলসি খোলা কমলেও চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। কারণ আগের বকেয়া এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তিন হাজার ৩৫৪ কোটি ডলার বা ৩৩.৫৪ বিলিয়ন ডলার এলসি নিষ্পত্তি করা হয়। গত অর্থবছরের একই সময় দুই হাজার ৭১৫ কোটি ডলার বা ২৭.১৫ বিলিয়ন ডলার এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল। সে হিসাবে এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নতুন এলসি কমছে। যদিও বাকি বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে আগে খোলা এলসির দায় পরিশোধ বেড়েছে। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এলসি খোলা ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর কারণ, এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে কোনো পণ্য আমদানি হয় না। বেশিরভাগ এলসির দেনা পরিশোধ হয় পণ্য দেশে আসার পর। অবশ্য সামপ্রতিক বছরগুলোতে বেশিরভাগ আমদানি হচ্ছে বায়ার্স ক্রেডিট বা ডেভার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে। এ উপায়ে পণ্য পাওয়ার পর নির্ধারিত সময় শেষে এলসির দায় পরিশোধ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৬৩৯, আগস্ট ৬৬১, সেপ্টেম্বর ৬৫১, অক্টোবর ৪৭৪ এবং নভেম্বর ৪০২ কোটি ডলার। এ হিসাবে আগের মাসের তুলনায় নভেম্বরে নতুন এলসি কমেছে ২৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৭৪০, আগস্ট ৭৪০, সেপ্টেম্বর ৬৭২, অক্টোবর ৬৪১ এবং নভেম্বর ৫৬০ কোটি ডলার। এ হিসাবে আগের মাসের তুলনায় নভেম্বরে নিষ্পত্তি কমেছে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৪২ শতাংশ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলেও দেশের বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতি কমাতে পারেনি। বরং চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫৮ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯১৬ কোটি ডলার। সে হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে ৪২ কোটি ডলার।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতি ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় এ ঘাটতি ছিল ৩.৮৩ বিলিয়ন ডলার। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও যেহেতু বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না তাই নিকট ভবিষ্যতে আমদানি নির্ভর পণ্যে সুখবর মিলছে না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।