Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বিচারে কাজে আসছে না ভিডিও ফুটেজ

প্রিন্ট সংস্করণ॥শরিফ রুবেল

অক্টোবর ২৬, ২০১৯, ০৬:৫৫ পিএম


বিচারে কাজে আসছে না ভিডিও ফুটেজ বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির ফলে মানুষের জীবনের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তি। মানুষ দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল কাজেই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। এমনকি মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অপরাধ ঘটছে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে সুদক্ষ অপরাধীরাও যেকোনো অপরাধ বা হত্যাকাণ্ড করার সময় নিজের অজান্তেই রেখে যাচ্ছে অপরাধের নানা প্রমাণ সেটা অডিও, ভিডিও, ছবিও হতে পারে। সম্প্রতি আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও এমন হয়েছে। খুনিদের অজান্তেই সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে তাদের খুনের দৃশ্য। শুধু আবরার নয়, বর্তমানে এমন প্রচুর অপরাধ ঘটছে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে। যেগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়ে যাচ্ছে সেই ইন্টারনেট ও সংশ্লিষ্ট ডিভাইসগুলোতেই। যেমন— কোনো ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি বা চাঁদার জন্য ভীতি প্রদর্শন করে তাহলে সেটা দণ্ডবিধির অধীনে গুরুতর অপরাধ। আর কেউ যদি এই অপরাধগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে, ই-মেইল বা মোবাইলের মাধ্যমে ঘটিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে সংশ্লিষ্ট স্ক্রিনশট কিংবা মোবাইলের অডিও রেকর্ড, সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও, ইলেকট্রনিক মেইল, সোস্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন কমেন্টস, ডিজিটাল সিগনিচার, মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড, টেক্সট রেকর্ড, এটিএম ট্রান্স্যাকশন লগ, ওয়ার্ড প্রসেসিং ডকুমেন্ট, ইন্টারনেট ব্রাউসার হিস্টোরি, গ্লোবাল প্রসেশনিং সিস্টেম ট্র্যাক, কম্পিউটার ব্যাকআপ প্রভৃতি। কিন্তু প্রযুক্তিগত এসব প্রমাণের বিষয় সম্পর্কে সাক্ষ্য আইনে কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় এসব জিনিস সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণে বিচারক ও আইনজীবীকে গলদঘর্ম হতে হয়। অনেক সময় আইনের দোহাই দিয়ে এগুলো তারা সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণও করে না। এতে করে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ দেশের কোনো আদালতেই ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করাই সম্ভব না। এমনকি ১৪৮ বছরের পুরানো সাক্ষ্য আইনেও এর বিধান নেই। সাক্ষ্য আইনে যেসব সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ৩নং ধারায় প্রধানত দুই রকম সাক্ষ্য বা প্রমাণের কথা বলা হয়েছে। প্রথমে মৌখিক সাক্ষ্য, দ্বিতীয় দালিলিক সাক্ষ্য। মৌখিক সাক্ষ্য হলো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হয়ে যা কিছু বর্ণনা করেন বা মুখে বয়ান করেন। আর দালিলিক বা ডকুমেন্টারি সাক্ষ্য হলো আদালতের নিরীক্ষণের জন্য যেসব প্রমাণাদি, দলিলাদি, নথিপত্র হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে ডিজিটাল এভিডেন্স সাক্ষ্য আইনে বর্ণিত দালিলিক বা ডকুমেন্টারি সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে না। ডিজিটাল এভিডেন্স সাক্ষ্য আইনের ৩নং ধারা অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য না। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতে সাক্ষ্য আইনের ৩(১)নং উপধারা সংযোজন করায় ডিজিটাল, ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যকে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সাক্ষ্য আইন মোতাবেক ডকুমেন্ট বা দলিল বলতে স্মারক হিসেবে ধরে রাখার জন্য কোনো অক্ষর, সংখ্যা ও চিহ্ন যা কোনো বিশেষ অবস্থার ইঙ্গিত করে বা বুঝায়। আইনের ৩নং ধারায় বর্ণিত ৫টি ইলাট্রেশনের কোনো লেখা, প্রিন্টের মাধ্যমে কোনো ছবি, মানচিত্র বা ব্যঙ্গচিত্রকে দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ইলেকট্রনিক অডিও, ভিডিও বা ভিজুয়াল রেকর্ডকে সুস্পষ্টভাবে দলিল হিসেবে বলা হয়নি। দালিলিক আর মৌখিক সাক্ষ্যের বাইরে আরেক ধরনের সাক্ষ্যও বিচারকাজে মাঝেমাঝে ব্যবহার হয়, যেটাকে বলা হয় বস্তুগত বা বাস্তব সাক্ষ্য। আদালত অঙ্গনে যা আলামত নামে পরিচিত। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৫ ধারার বিধান অনুযায়ী তদন্ত কর্মকমর্তা অপরাধসংশ্লিষ্ট যেকোনো আলামত জব্দ করতে পারেন এবং এইসব আলামতের নির্দিষ্ট কোনো প্রকার নেই, আলামত বলতে ভিডিও ফুটেজ বা কোনো অডিও রেকর্ডও হতে পারে। ১৮৭২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৬০-এর ২নং শর্তাংশের বিধান ও ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারের ১৬১ বিধি অনুযায়ী আদালতে বিচারের সময় আলামত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ফলে ডিজিটাল এভিডেন্সকে দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ না করার কোনো যুক্তি নেই। আবরার ও রিফাত হত্যার বিচার বাধাগ্রস্ত করবে কি পুরানো সাক্ষ্য আইন এমন অবস্থায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার সুস্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও হত্যাকাণ্ডের বিচারে এসব ভিডিও কাজে আসবে কি না তা নিয়েও আছে সংশয়। কারণ এসব ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেই আদালতে। এমনকি আইনেও এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মূলত সাক্ষ্য আইনের দুর্বলতার কারণেই সরাসরি আলামত হিসাবে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ আদালতে গ্রহণের বাধ্যবাধকতাও নেই। তাই এ মামলার প্রমাণে ভিডিও ফুটেজ ব্যবহারের জন্য নির্ভর করতে হবে মামলার তদন্তকারী প্রসিকিউশনের সক্ষমতা ও বিচারকের বিবেচনার ওপর। অপরদিকে বরগুনায় আলোচিত রিফাত হত্যা, শিবির সন্দেহে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা, শিশু রাজন হত্যা, গাইবান্ধার সাবেক সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা, রাজধানীর বাড্ডায় গুজবের শিকার রেনু হত্যা ইত্যাদি মামলার ঘটনায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজই প্রমাণ করে কারা ওই খুনের সাথে জড়িত। এমনকি এসব হত্যায় ভিডিও ফুটেজ ছাড়া তেমন কোনো প্রমাণও নেই। আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যার সময় ধারণকৃত ভিডিওটিও বিচারে কোনো কাজে লাগেনি। ফলে আসামিরা সবাই আইনি ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে এসেছেন। সিলেটে খাদিজাকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা কিংবা বুয়েট ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সিসিটিভি ক্যামেরার ধারতকৃত ভিডিও ফুটেজই মূল প্রমাণ। কিন্তু ১৮৭২ সালের পুরানো সাক্ষ্য আইনের ৩য় ধারায় প্রমাণ হিসাবে যে পাঁচটি উদাহরণ দেয়া আছে তাতে অডিও বা ভিডিও রেকর্ডকে উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করার কোনো বিধান নেই। ফলে ধারণকৃত এসব ভিডিও বা অডিও প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ বিচারকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যার পর আবরার হত্যা নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের কোনো আদালতেই অডিও-ভিডিও উপস্থাপনের প্রযুক্তিগত কোনো সুযোগ নেই। এমনকি সাইবার ক্রাইম আদালতেও নেই এ সুযোগ। এমন জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এবং সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ও ডিআইজি মিজানের ঘুষ লেনদেনের অডিও-ভিডিওকে প্রমাণ হিসাবে রাখাতে গিয়ে গত ২১ আগস্ট বিচারিক কার্যক্রমে ইলেকট্রনিক রেকর্ডকে (অডিও-ভিডিও) সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে সাক্ষ্য আইন-১৮৭২ যুগোপযোগী করার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য আইন সংশোধনের এই প্রস্তাব চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ অবস্থায় আবরার হত্যার মোড় ঘুরানো এই ভিডিও ফুটেজ বিচারে কোনো কাজে আসবে কি না— তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। তাই তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দ্রুত ১৪৭ বছরের পুরানো সাক্ষ্য আইন পরিবর্তনের তাগিদ দিয়েছেন আইনপ্রণেতারা। যেভাবে এসেছে সাক্ষ্য আইন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ১৮৭২ সালে সাক্ষ্য আইন প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরানো সাক্ষ্য আইনই এদেশেও চলতে থাকে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আইনিব্যবস্থায় পদ্ধতিগত আইন হিসেবে সাক্ষ্য আইন প্রচলিত আছে। আইনি সংশোধনে বিশিষ্টজনের মতামত সাক্ষ্য আইন সংস্কার চেয়ে দুদকের পাঠানো চিঠির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আমার সংবাদকে বলেন, মাস দুয়েক আগে দুদক থেকে বিদ্যামান সাক্ষ্য আইন সংশোধন করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে আইন কমিশন এ ব্যপারে একটা খসড়া দিয়েছে আশা করি শিগগিরই এ আইন সংস্কার করা হবে। আমি মনে করি, নতুন করে সাক্ষ্য আইন না করে পুরানো সাক্ষ্য আইনের ভিতরেই সংস্কার করে ডিজিটাল কিছু বিষয় সংযোজন করলেই হবে। আবরার হত্যাকাণ্ডে অনেকগুলো পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য আছে। তাই বিচারে সমস্যা হবে না। শুধু ভিডিও ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে সাজা দেয়া হলে তখন অনেকগুলো আইনগত প্রশ্ন ওঠে। কাজেই এটা দূর করার জন্য সাক্ষ্য আইন সংস্কার করা অতি জরুরি। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আমার সংবাদকে বলেন, সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। এখন প্রযুক্তির যুগ। সাম্প্রতি সময়ে অপরাধীরাও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নানা অপরাধ করছে। কিন্তু আইনের গলদের কারণে তাদের শাস্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই এ আইন সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সরকার এদিকে কোনো নজর দিচ্ছে না। আমাদের আইন মন্ত্রণালয়ের অনেক দুর্বলতা আছে। কারণ তারা কোনো কাজই ঠিকমত গুরুত্ব দিয়ে করতে পারেন না। আর যেকোনো আইনি বিষয় সেখানে গেলে মাসের পর মাস সেটা ফাইলবন্দি থাকে। এর কোনো সুরাহা হয় না, এটা প্রত্যাশিত নয়। যেকোনো বিষয়েই আইনমন্ত্রীরও গাফিলতি আছে। তিনি সময়েরটা সময়ে করেন না। আইন যদি সঠিক না হয় তাহলে সুশাসন আনা মোটেও সম্ভব নয়। আবরার হত্যায় আসামিদের শাস্তি দেয়ার বিভিন্ন উপায় আছে। কারণ আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আছে। এটা দিয়েও বিচার করা যাবে। তারপরও ভিডিওটা উপস্থাপন করতে পারলে একটু বুবিধা হতো। সুপ্রিমকোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, সাক্ষ্য আইনে ভিডিও অডিও প্রদর্শনের সুযোগ নেই, ঠিক আছে কিন্তু এটা যুগ উপযোগী করার প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুতই এটা সংস্কার করা হবে। সাক্ষ্য আইনে না থাকলেও হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এটা কিন্তু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। তবে এটা সংস্কার যেহেতু সময়ের দাবি তাই আইন মন্ত্রণালয় এটা গুরুত্ব দিয়েই সংশোধনের জন্য কাজ করছে। সাক্ষ্য আইনে উল্লেখ না থাকলেও ভিডিও ফুটেজ আলামত হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এসটিএমএ