Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪,

বছরে অর্ধ লক্ষাধিক মৃত্যু রক্তের অভাবে

প্রিন্ট সংস্করণ॥মাহমুদুল হাসান

জানুয়ারি ৩১, ২০২০, ০৭:৪১ পিএম


বছরে অর্ধ লক্ষাধিক মৃত্যু রক্তের অভাবে
  • ১৩ লক্ষাধিক ব্যাগ রক্তের চাহিদা
  • ১০ শতাংশ রক্ত আসে মাদকসেবীর শরীর থেকে
  • প্রয়োজনের ৪০ শতাংশ রক্ত পাওয়া যায় না
রক্ত! যার বিকল্প এখনো তৈরি করতে পারেনি বিজ্ঞানের এ উৎকর্ষতা। চিকিৎসার প্রয়োজনে একে অন্যের রক্তে নতুন করে প্রাণশক্তি ফিরে পায়। নব্বইয়ের দশকে চাহিদার অনুপাতে রক্তের যোগান কম ছিলো। এক দশক আগেও যেখানে ৭০ শতাংশ রক্তের চাহিদা পেশাদার রক্তদাতা থেকে মেটানো হতো। কিন্তু পাল্টেছে প্রেক্ষাপট। পেশাদার রক্তদাতা এখন ১৫ শতাংশের মতো রক্তের যোগান দিয়ে থাকে। এ সাফল্যের পেছনে দেশের তরুণ প্রজন্মের অবদান রয়েছে। তারা নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন করতে সারা দেশে স্বেচ্ছায় কাজ করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি বছর দেশে রক্তের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সরবরাহও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণ করছে। এর মধ্যে কিছু কেন্দ্রে হেপাটাইটিস বি-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মধ্যে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, সন্ধানী ও রেড ক্রিসেন্ট অন্যতম। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলো শহরকেন্দ্রীক হওয়ায় তৃণমূলে রক্তের ঘাটতি থেকেই যায়। রক্তের ঘাটতি থাকার প্রধান কারণ আমাদের অসচেতনতা। এক জরিপে দেখা গেছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের বেশি মৃত্যু হয়। যাদের অধিকাংশ শহুরে জীবনের বাইরে মৃত্যুবরণ করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপে উঠে এসছে— বছরে প্রায় চার লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। গেলো ২০১৯ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ব্যাগে। ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে রক্তের চাহিদা বেড়েছে তিন গুণের বেশি। এর মধ্যে ৩৫-৪০ ভাগ পাওয়া যায় রোগীর নিকটজন থেকে, ১৫-২০ ভাগ স্বেচ্ছাসেবী থেকে ও ১৫-২০ ভাগ পেশাদার রক্ত-বিক্রেতা থেকে। বাকি ২০-২৫ ভাগ বা প্রায় ২.৫ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি থেকে যায়। ঘাটতি ও অনিরাপদ রক্তের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ লাখ। চাহিদার অনুপাতে রক্ত না পেয়ে বছরে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ মারা যান। অন্যদিকে পেশাদার বিক্রেতারা যে ১৫-২০ শতাংশ রক্তের যোগান দেন তা অনিরাপদ। কেননা তারা অধিকাংশ মাদকসেবী। মাদকের টাকা জোগাড় করতে নিয়মিত রক্ত বিক্রি করে থাকে। মাদকসেবীদের রক্ত গ্রহণ করা বিপজ্জনক। এদের রক্তে থাকে হেপাটাইটিস, এইডস, সিফিলিসসহ নানা রোগের জীবাণু। এদের রক্ত নেয়ার পর রোগী প্রাণে বাঁচলেও পরে যে মারাত্মক রোগে ভোগেন; যা রোধের উপায় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন। রক্ত নিয়ে এসব অপকর্ম রুখতে, ২০০৮ সালে সরকার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রক্ত দেয়া ও নেয়ার জন্য নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালা প্রণয়ন করেন। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে রক্ত আদান-প্রদানের আগে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই বিধিমালার অনেক কিছুই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এতে আতঙ্কিত হচ্ছে রোগী ও তার স্বজনরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, একজন সুস্থ ব্যক্তি বছরে তিনবার রক্ত দিতে পারে। উন্নত বিশ্বে প্রতি হাজারে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় ৪৫০ জন বা শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি হাজাওে মাত্র তিনজন রক্ত দেয়। রক্তদাতার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দেশের ঘাটতি পূরণ ও অনিরাপদ রক্তের ব্যবহার বন্ধ করতে বর্তমানের চেয়ে বছরে মাত্র পাঁচ লাখ ব্যাগ অতিরিক্ত সংগ্রহ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২০ সালে আমাদের দেশে চাহিদার শতভাগ স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২ শতাংশ লোক বছরে একবার রক্তদান করলে আমাদের দেশে রক্তের অভাব থাকবে না। তাই গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকারি উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলে ব্লাডব্যাংক না থাকলেও সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন গ্রামেও স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন গড়ে ওঠেছে। এমন একটি সংগঠন জাজিরা ব্লাডব্যাংক। গত তিন বছর আগে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে ফেসবুক ভিক্তিক এই রক্তদাতাদের সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। ইতোমধ্যে তারা প্রায় সাত শতাধিক ব্যাগ রক্তও ম্যানেজ করে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করা বিষয়ে সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মো. পলাশ খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘রক্ত দেয়া নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ট্যাবু ধারণা ছিলো। মানুষ রক্ত দিতে ভয় পেতো। এখন পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমাদের তরুণদের উচিত হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করা। আমরা বিশ্বাস করি তরুণদের এই অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকলে কোনো মানুষ আর রক্তের অভাবে প্রাণ হারাবে না। এ প্রসঙ্গে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের রক্ত সংগ্রহ কর্মসূচির সমন্বয়ক শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, বাণিজ্যিকভাবে সংগ্রহ করা রক্ত নিরাপদ কি-না তা বলা কঠিন। কারণ ওই জায়গায় যারা রক্ত বিক্রি করেন তারা মাদকাসক্ত। তাদের রক্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। গ্রামের রক্তের অভাব পূরণের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রামে পর্যাপ্ত রক্তদাতা না থাকায় বছরে অনেক প্রাণহানি ঘটে। দেশের মানুষের মধ্যে রক্তদান নিয়ে ভীতি আছে। তাদের এই ভীতি দূর করা গেলেই নিরাপদ স্বেচ্ছায় রক্তদান নিশ্চিত হবে। এ সমস্যা নিরসণে উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফ্রি ব্লাডগ্রুপিং কর্মসূচি হাতে নিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের ডাটা সংগ্রহ কতে পারে। সেই সাথে গ্রামের মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। উন্নত বিশ্বে প্রচারণা চালানো হয়। নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়া আপনার নাগরিক দায়িত্ব। বছরে কেউ তিনবার স্বেচ্ছায় রক্ত দিলে তার এক ভাগ ট্যাক্স মওকুফ করা হবে। এমন প্রচারণা চালালে দেশে আরো স্বেচ্ছায় রক্তদাতা বাড়বে। রোগীরা প্রয়োজনে নিরাপদ রক্ত পাবে। মৃত্যুর হার কমে আসবে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন প্রোগাম প্রজেক্ট ম্যানেজার ও জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেখ দাউদ আদনান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য শতভাগ মানুষের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় পরিশুদ্ধ রক্ত নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে দেশের স্বেচ্ছায় রক্তদানে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা সহযোগিতা করে আসছি। সংগঠনগুলোর কর্মীদের মানোন্নায়ন ও মনিটরিং করছি।’ গ্রামের মানুষ প্রয়োজনীয় রক্ত পায় না স্বীকার করে তিনি বলেন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী (মো. নাসিম) মহোদয়ের অনুরোধে আমরা কয়েকটি সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ব্লাডব্যাংক খুলেছিলাম। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে সেগুলো চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর গ্রামের মানুষের রক্তের চাহিদা যথাযথভাবে মেটানোর জন্য আমরা জেলা যুব রেডক্রিন্টেকে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে ইউনিট চালু করার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা সেটা চালু করেনি। স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের সংগঠনগুলো শহরমুখী কারণ এগুলো ছাত্ররা পরিচালনা করে। আর তাই তাদের প্রচেষ্টাও গ্রামে নেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংগঠকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমারসংবাদ/এসটিএমএ