Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫,

জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন সংকটে সরকারি হাসপাতালগুলো

আব্দুল লতিফ রানা॥প্রিন্ট সংস্করণ

আগস্ট ২৮, ২০১৭, ০৫:২৯ এএম


জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন সংকটে সরকারি হাসপাতালগুলো

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাকসিনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সুযোগে একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি একচেটিয়া ভ্যাকসিন বাজারজাত করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে ভ্যাকসিনের এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্য জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্তদের স্বজনরা নির্দিষ্ট ওই কোম্পানির ভ্যাকসিনটি ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন।

জানাগেছে, ওই ভ্যাকসিনটি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির। ভ্যাকসিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও অনুমোদন দেয়নি বলেও জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রূহুল আমিন আমার সংবাদকে জানান, ইনসেপ্টার ভ্যাকসিনটি বাজারজাত করতে আমরাই অনুমোদন দিয়েছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন না দিলেও কোনো সমস্যা নাই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কো-অর্ডিনেশন সেলের প্রধান প্রফেসর ডা. বেনজীর আহমেদ সরকারি হাসপাতালগুলোতে কুকুরের কামড়ের টিকা বা ভ্যাকসিন সরবরাহ সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আগে দেশের মানুষ ঝাড়-ফুঁ-এ বিশ্বাস করতো, এখন আর বিশ্বাস করে না। তারা এখন হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে সাধারণ মানুষ অনেক সচেতন হয়েছেন। এই টিকা বা ভ্যাকসিন শুধু ইনসেপ্টা কোম্পানিই সরবরাহ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ভ্যাকসিনটি এখনও অনুমোদন দেয়নি বলেও তিনি স্বীকার করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুকুর, বিড়াল বা শেয়ালে কামড়ানো ব্যক্তিদের র‌্যাবিস ভ্যাকসিন বা টিকা সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দিতে হয়। প্রত্যেক জলাতঙ্ক রোগীকে ৪টি করে টিকা দিতে হয়। প্রতিটি টিকার দাম ১২শ টাকা বলে জানা গেছে। প্রত্যেক সরকারি হাসপাতালের সামনের ওষুধের দোকানগুলো
ইনসেপ্টা কোম্পানির ওই টিকা উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করে। কুকুরে কামড় দেওয়া রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে যাওয়ার পর তাদের বাইরে থেকে ১২শ থেকে সাড়ে ১২শ টাকা দিয়ে ইনসেপ্টা কোম্পানির ভ্যাকসিন বা টিকা ক্রয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে বলেও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন কুকুর মারার জন্য টাকা ভাগাভাগি করে নিত। এখন আর তা করা হয় না। কুকুরের প্রজনন ক্ষমতা বন্ধ করা হচ্ছে। আবার ডিসিসির নিয়মানুযায়ী কুকুর পোষার জন্য সিটি করপোরেশনের একটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড নিতে হয়। সেক্ষেত্রে ১০০ টাকা জমা দিয়ে কার্ড নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাণীর গলায় একটি টোকেন দেয়া হয়। এরপর ভ্যাকসিন দিতে হত। বেওয়ারিশ কুকুরের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন নিয়মানুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর অভিযান চালিয়ে মেরে ফেলা হতো। এখন আর তা করা হয় না। এখন বন্ধ্যাত্বকরণ করা হচ্ছে। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে কুকুরের বন্ধ্যাত্বকরণ করা হচ্ছে। গত অর্থ বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ১১শ কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭শ কুকুরকে বন্ধ্যা করা হয়েছে। ৪শ কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভেটেরিনারি চিকিৎসক ডা. আজমত আলী এ তথ্য জানিয়ে বলেন, চলতি অর্থ বছরের কুকুর বন্ধ্যাকরণ বা ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ এখনও হয়নি, কাজও শুরু হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক জানান, আমাদের দেশে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যান। ভাইরাসজনিত র‌্যাবিস জীবাণু দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হলে যে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাকে জলাতঙ্ক রোগ বলা হয়। কুকুর, শেয়াল, বিড়াল, বানর, গরু, ছাগল, ইঁদুর, বেজি, র‌্যাবিস জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে এবং মানুষকে কামড়ালে এ রোগ হয়ে থাকে। এটি একটি মারাত্মক রোগ। যা একবার হলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বর্তমানে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ভ্যাকসিন নিলে ভয়ের কিছু নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগে কুকুর কামড়ালে নাভির চারদিকে চরম কষ্টদায়ক ১৪টি ইনজেকশন দেয়া হতো। এক শ্রেণির মানুষ গুজব ছড়াতেন যে, কুকুরে কামড়ানো মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়। জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়। কুকুরে কামড়ানো এ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন বা রাবিপো দেশের ৬৪টি জেলাতেই খুব সহজে বিনামূল্যেই পাওয়ার কথা প্রচার করা হলেও বাস্তবে তার বাস্তবায়ন নেই। আমাদের রাজবাড়ী প্রতিনিধি মেহেদী হাসান মাসুদ জানান, কুকুরে কামড়ের বা জলাতঙ্ক রোগের র‌্যাবিস ভ্যাকসিন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে পাওয়া যায় না। যদিও জেলা হাসপাতালে থাকার কথা বলা হলেও তা বাইরের দোকান থেকে রোগীর স্বজনরা কিনে আনতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজবাড়ি জেলার সিভিল সার্জন ডা. রহিম বক্স আমার সংবাদকে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, উপজেলা হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয় না। জেলা হাসপাতালে দেওয়া হলেও তা অপ্রতুল বলে জানান তিনি।

আমাদের শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না। জেলা হাসপাতালে থাকলেও হাসপাতালের লোকজন বাইরের দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি কাউসার জানান, জেলা সিভিল সার্জন আজিজুল ইসলাম সিদ্দিক বলেছেন, জেলার থানাগুলোতে কুকুরের কামড়ের ভ্যাকসিন দেওয়া হয় না। জলাতঙ্ক রোগীদের চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে আনা হলে সেখানে এ রোগের টিকা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। টাঙ্গাইল জেলা হাসপাতালে আবুল বাশার নামের এক ব্যক্তি তার শিশু সন্তানকে কুকুরের কামড়ের ভ্যাকসিন দিতে আসেন। তার কাছে হাসপাতালের কর্মচারীরা ১২শ টাকা দাবি করেন। এরপর তাকে বাইরে থেকে ওই টিকা সাড়ে ১২শ টাকায় ক্রয় করতে বাধ্য করেন।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা সিনিয়র শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মঞ্জুর হাসান তালুকদারের সেল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলছেন, কুকুরে না কামড়ালেও আগে থেকে টিকা দেওয়া যায়। কামড় দেওয়ার প্রথম দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ৪টি টিকা দিতে হবে। কুকুর কামড়ালে ক্ষতস্থান সাবান পানি দিয়ে প্রায় ১০ মিনিট ধরে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপর পভিডন আয়োডিন দিতে হবে। ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ, কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে কখনও বেঁধে দেওয়া যাবে না। এছাড়া, জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে এমন কুকুর বা অন্য পশু কামড় বা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেওয়া উচিত। আগে বলা হতো, কোনো কুকুর কামড়ালে সেই কুকুরকে ১০ দিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ১০ দিনের মধ্যে কুকুরটি মারা না গেলে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন সে ধারণা সত্য নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের এক সূত্র জানায়, ৫০০ জন জলাতঙ্ক রোগী নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, এর মধ্যে ৭৫ জনের ক্ষেত্রেই দায়ী কুকুরগুলো দীর্ঘদিন জীবিত ছিল। তাছাড়া সম্পূর্ণ সুস্থ কুকুরও জলাতঙ্কের জীবাণু বয়ে বেড়াতে পারে। জলাতঙ্ক রোগে কোনো কুকুর আক্রান্ত হলে পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করে। সামনে মানুষ বা পশু যাকেই পায় তাকেই কামড়াতে চেষ্টা করে। আর কুকুরটি সর্বক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে (লালার সাথে জীবাণু নির্গত হয়)। কুকুরটি খাওয়া বন্ধ করে দেয়, নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়। কুকুর বা অন্য কোনো পশু কামড়ালে দিশাহারা না হয়ে কুকুরটিকে ঘেরাও করে পর্যবেক্ষণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জলাতঙ্ক আক্রান্ত মানুষের লক্ষণ হচ্ছে, কামড়ের জায়গায় ব্যথা ও চিনচিন করে। জ্বর, ঢোক গিলতে ব্যথা ও খিঁচুনি হয়। পানি খেতে চায় না, পানি দেখলে ভয় পায়। খুব ঘন চটচটে লালা ঝরে। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ রেগে যাবে।

এরপর রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় এবং পক্ষাঘাত দেখা দেয়। ডা. নুরুন্নাহার নামে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, কুকুরে কামড়ের জলাতঙ্ক রোগটি ছোঁয়াচে। এ রোগের জীবাণু র‌্যাবিস ভাইরাস প্রাণীর লালায় বাস করে। তাই কুকুরে কামড়ালে ক্ষতের রক্তের মাধ্যমে এ ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে এবং রোগটি দেখা দেয়। শরীরের যেকোনো অংশে রক্তের সংস্পর্শে এলেই এটি সংক্রমিত হয়। কুকুর দ্বারা কামড়ানো জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত মানুষকে এ রোগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জীববিজ্ঞানী লুই পাস্তর ১৮৮৫ সালে ৬ জুলাই জোসেফ মিয়েস্টার নামক এক বালকের দেহে এই টিকা সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন এবং বালকটি ভালো হয়ে ওঠে। তারপর হতে সারা বিশ্বে সফলতার সাথে এ টিকা জলাতঙ্কের রোগের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত প্রাণী উন্মাদের মতো সবাইকে এবং সবকিছু কামড়ানোর প্রবণতা, উদ্দেশহীনভাবে ছোটাছুটি করা, মুখ থেকে অত্যধিক লালা নিঃসৃত হওয়া, ঘন ঘন ঘেউ ঘেউ বা বিড় বিড় শব্দ করা। একপর্যায়ে গলার মাংস পেশিতে পক্ষাঘাত হওয়ায় ঘেউ ঘেউ করতে না পারা, হাপ টেনে শ্বাস নেওয়া। ক্ষেত্রবিশেষে এমন রোগের আক্রান্ত প্রাণীর মধ্যে উত্তেজনা ভাব প্রকাশ না পেয়ে চুপচাপ থাকতে পারে এবং গৃহের এক কোণে ঘুমায় অনেক দিনের আক্রান্ত হলে। এই রোগটি সুপ্তাবস্থায় মানুষের শরীরে থাকে এক মাস থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত। আতে আক্রান্ত মানুষ অন্য আক্রান্ত প্রাণির মতো অন্য মানুষকে কামড়াতে চায়। আর পানি দেখলে ভয় পায়, পানি পান করতে পারে না।

এদিকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশ থেকে জলাতঙ্ক নির্মূলের লক্ষ্যে গত ১৭ আগস্ট গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সভাকক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ড কুকুরের টিকাদান কার্যক্রমের অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কো-অর্ডিনেশন সেলের প্রধান প্রফেসর ডা. বেনজীর আহমেদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. শেখ মো. আব্দুস সামাদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সহকারী পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন প্রমুখ চিকিৎসক কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় জলাতঙ্ক রোগ, এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে দ্বিতীয় রাউন্ড ব্যাপক হারে কুকুরে টিকা প্রদান কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা ও সকলের নিকট তথ্য পৌঁছানোর আহবান জানানো হয়।