নভেম্বর ১৭, ২০২২, ০৬:৪৬ পিএম
দরজায় কড়া নাড়ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। আগামী ২০ নভেম্বর পর্দা উঠবে এই ফুটবল মহাযজ্ঞের। পুরো একটি মাস ফুটবল প্রেমীদের চোখ আটকে থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। আয়োজনের যেন কোনো কমতি নেই দেশটিতে।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে আমরা দেখি ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ কিংবা বিশ্বনাগরিকের মেলবন্ধন হিসেবে। বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষদের নাড়িয়ে দেয়, আন্দোলিত করে, বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টি কেবল ফুটবলে নিবন্ধ করে সেটা আর কোন খেলায় হয় না।
নানা প্রান্তের মানুষদের সব চোখ একটা নির্দিষ্ট বস্তুতে নিবদ্ধ করতে বাধ্য করে। নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব না থাকা সত্ত্বেও এই সময়ে আমরা প্রত্যেকেই হয়ে যাই বিশ্বনাগরিক। কেবল বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ অন্তত বিশ্বকাপের মাসে হয়ে পড়ে একেকজন বিশ্বনাগরিক।
শূন্য থেকে শুরু যে ফুটবলের সেই ফুটবল আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের বিনোদনের, উৎসবের, উপভোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বিশ্বকাপটা যেমন উপভোগের; ঠিক তেমনি এই টুর্নামেন্টে নানা সময় ঘটে নানা অঘটন। প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপেই কিছু না কিছু অঘটন ঘটে।
এ পর্যন্ত হওয়া ২১টি বিশ্বকারে আসর হয়েছে। আর তাতে কম অঘটন দেখেনি বিশ্ব। তবে এত অঘটনের মাঝে আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো হাতে গোনা কয়েকটি অঘটন।
২০১৮ বিশ্বকাপে দ. কোরিয়ার কাছে জার্মানির হার : গেল বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। এর আগের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জার্মানি। ঠিক তারপরের বিশ্বকাপেই দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলের কাছে ২-০ গোলে হেরে যায় জার্মানি। এই হারে অঘটনের জন্ম দেয় দ. কোরিয়া।
জার্মানির কাছে ঘরের মাঠে ব্রাজিলের ৭ গোল হজম, ২০১৪ বিশ্বকাপ : নিজেদের ঘরের মাঠ, সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ জার্মানি। সেমিফাইনালের বাধা পার হলেই ষষ্ঠ শিরোপার খুব কাছে চলে যেত ব্রাজিল। দলের প্রাণভোমরা নেইমার এবং অধিনায়ক থিয়াগো সিলভাকে ছাড়াই সেদিন খেলতে নামে ব্রাজিল। তবুও তাদের সমর্থরা মাঠে এসেছিলেন এক বুক আশা নিয়ে।
ঘরের মাঠে এমনিতেই এগিয়ে সেলেসাওরা। খেলার প্রথম ১০ মিনিট দু`দলই ছিল ছন্নছাড়া। ২৩ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোসার ইতিহাস গড়া গোল। এই গোলে বিশ্বকাপে এক খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড গড়েন ক্লোসা। ৩০ মিনিটেই জার্মানি এগিয়ে যায় ৫-০ গোলে।
এরপর দ্বিতীয়ার্ধে আরো দু`টি গোল করে জার্মানরা। ম্যাচের ৯০ মিনিটে অস্কারের গোল ব্রাজিলিয়ানদের কষ্ট আরো বাড়িয়েছিল কেবল। ১৯৫০ এর মারাকানাজোর পর আরেকবার নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ থেকে কান্না নিয়ে বিদায় নেয় ব্রাজিল। যা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে পরাজয়।
তবে এই ম্যাচটির প্রেক্ষাপট অন্য ম্যাচগুলোর মতো নয়। সেমিফাইনালের মতো জায়গায় জিততে পারে যে কেউ। কিন্তু ম্যাচের স্কোরলাইনই এটিকে সেরা অঘটনের তালিকায় রাখতে বাধ্য করেছে।
সেনেগালের কাছে ফ্রান্সের হার, ২০০২ বিশ্বকাপ : হারজিত খেলারই একটি অংশ। কিন্তু কিছু কিছু হার এমন হয় যা ইতিহাস গড়ে দেয়। ২০০০ সালের ইউরোপজয়ী দল ফ্রান্স ২০০২ বিশ্বকাপে গিয়েছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা ৩টি আন্তজার্তিক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হবার হাতছানি ছিল তাদের সামনে।
২০০২ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট এবং সেরা দলও ছিল ফ্রান্সের। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল আফ্রিকান দেশ সেনেগাল। তুলনামূলকভাবে ফ্রান্সের চেয়ে অনেক কম শক্তিশালির দল ছিল সেনেগাল। সেই সেনেগালই ফ্রান্সকে হারিয়ে দেয় ১-০ গোলে। যা বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় অঘটন বলে বিবেচিত।
ম্যাচের ৩০ মিনিটে পাপা বউবা দিওপ একমাত্র গোলটি করেন। বিশ্বজয়ের মুকুট রক্ষা করতে এসে ইতিহাসের প্রথম রাউন্ডেই বাড়ির পথ ধরে ফ্রান্স।
ক্যামেরুনের কাছে আর্জেন্টিনার হার, ১৯৯০ বিশ্বকাপ : ১৯৮৬ সালের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। পরের বিশ^কাপ অর্থাৎ ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এসেছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। দলে ছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেই আর্জেন্টিনাই কিনা গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই হেরে বসে আফ্রিকান সিংহ নামে খ্যাত ক্যামেরুনের কাছে।
ম্যাচের শুরু থেকেই ক্যামেরুনের পরিকল্পনা ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে আটকানো। যার ফলে ম্যারাডোনাকে ট্যাকল করে ক্যামেরুনের দু`জন লাল কার্ড দেখেন। কিন্তু নয় জনের দল নিয়েই ম্যাচের ৬৭ মিনিটে ফ্রাঙ্কো ওমাম বিয়িকের গোল অঘটনের জন্ম দেয়।
ক্যামেরুন কেবল গ্রুপ পর্বেই থেমে থাকেনি, কোয়ার্টার ফাইনালও খেলেছিল তারা। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ক্যামেরুনের জয়টিকে বিশ্বকাপে আফ্রিকান কোনো দলের সেরা মূহুর্ত বলেও আখ্যা দেয়া হয়।
উত্তর কোরিয়ার কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ ইতালি, ১৯৬৬ বিশ্বকাপ : ১৯৬৬ সালেল বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট হিসেবেই গিয়েছিল ইতালি। গ্রুপে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিলি এবং উত্তর কোরিয়া। একমাত্র এশিয়ান দল হিসেবে সেবার বিশ্বকাপে খেলেছিল উত্তর কোরিয়া।
গ্রুপ পর্বের ২ ম্যাচ শেষে পয়েন্ট দাঁড়ায় ইতালি ২, উত্তর কোরিয়া ১। পরের রাউন্ডে যেতে ইতালির ড্র হলেই যথেষ্ট, অন্যদিকে জিততেই হতো কোরিয়াকে। ম্যাচের ৪২ মিনিটে পাক দু ইকের গোল লিড এন দেয় উত্তর কোরিয়াকে। বাকি সময় সেটি ধরে রেখে বিশ্বকাপেরেই অন্যতম সেরা অঘটনের জন্ম দেয় তারা। এই হারে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে ইতালি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যান্ডের হার, ১৯৫০ বিশ্বকাপ : ১৯৫০ বিশ্বকাপে সৌখিন দল পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। গ্রুপ পর্বের ১ম ম্যাচে স্পেনের কাছে ৩-১ গোলের হারে যুক্তরাষ্ট্র। ২য় ম্যাচে তারা মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। ইংল্যান্ড তখন স্বীকৃতভাবেই বিশ্বের সেরা দল। সেই দলকেই কিনা মার্কিনিরা হারিয়ে দেয় ১-০ গোলে।
ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিটেই ইংল্যান্ড গোলমুখে ৬টি শট নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের গোলকিপার ফ্র্যাংক বোরগি অসাধারণ কয়েকটি সেভ করেন। ৩৭ মিনিটে জো গাটজেনস এর গোলই ম্যাচের একমাত্র গোল হিসেবে রয়ে যায়। ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এমনটি ঘটেছে।
প্রতি গ্রুপ থেকে মাত্র একটি দল পরের পর্বে যেতে পারতো বিধায় ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। পরের ৪০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
মেক্সিকোর কাছে জার্মানির হার, ২০১৮ বিশ্বকাপ : ২০১৪ বিশ্বকাপের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে রাশিয়ার বিশ্বকাপে আসে জার্মানি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে জার্মানদের প্রতিপক্ষ ছিলো মেক্সিকো। ম্যাচে শুরু থেকেই দারুণ উজ্জীবিত মেক্সিকান ওয়েভের সামনে খেই হারিয়ে বসে জার্মানি।
৩৪ মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে চাকি লোজানোর গোলে এগিয়ে যায় মেক্সিকো। এরপর শত চেষ্টা করেও ম্যাচে ফিরতে পারেনি জার্মানি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে হারের পর শেষ ম্যাচেও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় জোয়াকিম লো`র শিষ্যরা। আগের দুই বিশ্বকাপের মতোই ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ার ধারাও বজায় রাখে জার্মানি।
বিশ্বকাপ মানেই যেন অঘটন। প্রতি আসরেই কোনো না কোনো অঘটন ঘটছেই। এবার কাতার বিশ্বকাপও হয়তো নানা অঘটনের জন্ম দিবে। তবে কাতারে এবার কি ঘটে তা হয়তো আগে বলার কোনো সুযোগ নেই। তবুও অপেক্ষা করতে হবে শেষ পর্যন্ত।
মধ্যপ্রাচ্যের কন্ডিশনে এশিয়ান দলগুলো জাদু দেখাতেই পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান এমনকি স্বাগতিক কাতারও কোনো বড় দলকে রুখে দিয়ে বিশ্বকে চমকে দিতে নিশ্চয়ই প্রস্তুত। এমনটা হলে হয়তো অবাক হবে না বিশ্বের ফুটবল প্রেমীরা।
টিএইচ