আহমেদ হৃদয়
ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ০৯:০৯ পিএম
আহমেদ হৃদয়
ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ০৯:০৯ পিএম
লিওনেল মেসি; যিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শাসন করে যাচ্ছেন বিশ্বফুটবল। যার বাঁ পায়ের যাদুতে মোহিত হয়েছে সারা বিশ্ব। ৩৫ বছর বয়সেও তিনি অনবদ্য। দলকে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন সাফল্যের চূড়ায়। খুব সম্ভবত এটিই মেসির শেষ বিশ্বকাপ। তবে রেকর্ড ৭ বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী বিশ্বসেরা এই ফুটবলারের বিশ্বকাপের ট্রফিটা এখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি। এবার কী হবে সেই স্বপ্ন পূরণ! কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে বাংলাদেশ সময় আজ রাত একটায় ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে হারিয়েছে ক্রোয়েশিয়া।
নেইমারকে কান্নায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছেন মদরিচরা। তবে শেষ চারের লড়াইয়ে এবার লিওনেল মেসিকেও কান্নায় ভাসিয়ে সেমিফাইনাল থেকেই বাড়ি পাঠাতে চান ক্রোয়েটরা। বিশ্বকাপের গত আসরে আর্জেন্টিনা ছিটকে গিয়েছিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে, হেরেছিল ফ্রান্সের কাছে। তার আগে লিওনেল মেসিদের যন্ত্রণা দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল ক্রোয়েটরা। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের ম্যাচটি শুধু ফাইনালে ওঠার লড়াইয়েরই নয়, আর্জেন্টিনার জন্য ‘প্রতিশোধে’রও।
তবে আর্জেন্টিনার কেউ নয়; স্বয়ং ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচই এই কথা বলেছেন। গ্রুপ পর্বে মেক্সিকো ও পোল্যান্ড, দ্বিতীয় রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া আর কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে সেমিতে এসেছে লিওনেল স্কালোনির দল। শিরোপার অন্যতম দাবিদার হয়ে ওঠা আর্জেন্টিনা যে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গত বিশ্বকাপের হিসাব-নিকাশও চুকাতে চাইবে, সেটি ভালো করেই মনে আছেই ক্রোয়াট কোচের।
তিনি বলেছেন, এটা তো নিশ্চিত যে ওরা রাশিয়ায় হেরে যাওয়ার ম্যাচটি নিয়ে উদ্দীপনা হিসেবে নেবে। আমাদেরকে আক্রমণাত্মক আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হওয়ার কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে। ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনালে উঠেছে কোয়ার্টারে ব্রাজিলকে হারিয়ে। গতবারের রানার্সআপ দলটি মাঝমাঠের শক্তিতে ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে খেলে থাকে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তাদের মূল চ্যালেঞ্জ মেসিকে থামানো।
সেমিফাইনাল-প্রস্তুতি নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে ক্রোয়েট কোচ বলেছেন, মেসিকে কীভাবে থামানো যায় এই প্রশ্নে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। দলগত খেলায় ব্যক্তিগত নৈপুণ্য কাজ করে না। আমরা আগেও এ রকমটা করিনি, সামনেও করব না। তবে মেসিকে খেলার জন্য জায়গা কমিয়ে দিতে হবে। সে খুব বেশি দৌড়ায় না, বলের পেছনেও বেশি ছোটে না। সে অপেক্ষা করে, আর বল পাওয়ার পর নিজের শক্তি কাজে লাগায়। এ দিকটি নিয়ে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। এটাই হয়তো মেসির শেষ বিশ্বকাপ, আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জেতার শেষ সুযোগও। গত ১০ বছরের বিশ্বসেরা খেলোয়াড় সে।
ওকে সামলানোর জন্য আমাদের ভালোভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে। এদিকে ২০২২ সালের বিশ্বকাপে বারবারই আলবিসেলেস্তেদের শিবিরে উকি দিচ্ছে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ। মনে পড়ে সেই ৩২ বছর আগের বিশ্বকাপের কথা! ১৯৯০ বিশ্বকাপের জন্য আর্জেন্টিনাকে কোন বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ক্যামেরুনের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে যায় আলবিসেলেস্তেরা। তাদের দ্বিতীয় খেলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় লাভ করে আকাশী-নীল জার্সিধারিরা। তৃতীয় ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে দ্বিতীয় পর্বে খেলার সুযোগ পায় দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা।
দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাজিল। সেই ম্যাচে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্ল্যাভিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টিতে জয় পায় আকাশী নীলা। সেমিফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় তারা। খেলার নব্বই মিনিট ১-১ সমতায় শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে কোনও দলই গোল করতে না পারায় খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। পেনাল্টিতে জয় লাভ করে ফাইনালে পৌছায় আর্জেন্টিনা। টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও জার্মানি।
ফাইনালে বিতর্কিত পেনাল্টি থেকে খেলার একমাত্র গোলটি করেন জার্মানির আন্দ্রেস ব্রেহমি। শিরোপার খুব কাছে এসেও তা হাতছাড়া হয়ে যায় আর্জেন্টিনার। তবে কাতার বিশ্বকাপেও এখন পর্যন্ত সবকিছু ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপেও সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে। সেবারের মতো এবারও নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে বিশ্বকাপ শুরু করে আর্জেন্টিনা। তারপর এখনো পর্যন্ত আর কোনো ম্যাচ হারেনি মেসিরা। আজ ক্রোয়েটদের সঙ্গে ম্যাচ জিতলেই তারা চলে যাবে ফাইনালে। আলবিসেস্তেদের যেমন মনে পড়ছে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ; ঠিক তেমনি লুকা মদরিচের মনেও উকি মারছে কিছু স্মৃতি।
ক্রোয়াটদের প্রাণভোমরা যে লুকা মদরিচ, সেটি বলার হয়তো আর কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিপক্ষ হিসেবে আর্জেন্টিনা ক্রোয়াট তারকার কাছে যে বিশেষ কিছু। ক্রোয়েশিয়ার জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে মদরিচের অভিষেক যে আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই। তারিখটা ১ মার্চ, ২০০৬। সুইজারল্যান্ডের বাসেলে এক প্রীতি ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম মাঠে নামলেন ২০ বছর বয়সী মদরিচ। লিওনেল মেসিও তখন ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে। ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো ক্রাঞ্জকার ঝুঁকিটা নিয়েছিলেনই। মদরিচ তখন ক্রোয়েশিয়ার ক্লাব দিনামো জাগরেবের উঠতি তারকা। জার্মানিতে ২০০৬ বিশ্বকাপ শুরু হতে তখনো মাস তিনেকের মতো বাকি। মদরিচ সেদিন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাঠে নেমেই প্রমাণ করেছিলেন নিজের যোগ্যতা। তিনি যে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলের ভবিষ্যতের তারকা হতে চলেছেন, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে সেটার ভালোই ইঙ্গিত মিলেছিল।
অন্যদিকে আরও একটি ইতিহাস আত্মবিশ্বাস যোগাবে আর্জেন্টিনা শিবিরে। বিশ্বকাপে যতগুলো সেমিফাইনাল খেলেছে; তার একটিতেও হারেনি আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনাল মানেই আর্জেন্টিনা ফেবারিট! প্রতিপক্ষে যে দলই হোক। কাতার বিশ্বকাপের আগে এখন পর্যন্ত চারবার সেমিফাইনাল খেলেছে আর্জেন্টিনা। যেখানে একবারও হারের মুখ দেখতে হয়নি তাদের। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসরেই সেমিফাইনালে খেলে আর্জেন্টিনা।
এরপর ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে, ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপে এবং ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলেও সেবার টুর্নামেন্টের ফরম্যাটটা ছিল অন্য রকম। আর্জেন্টিনায় হওয়া সে বিশ্বকাপে প্রথমে ১৬টা দল ৪ গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলে। সেই চার গ্রুপের আট দল আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই গ্রুপে ভাগ হয়। এই দুই গ্রুপের সেরা দুই দল খেলেছে ফাইনাল। সেবার সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে যুক্তরাষ্ট্র হারে ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে। আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করেন লুইস মন্তি, আলেহান্দ্রো স্কোপেয়ি, গিলের্মো স্তাবিলে ও কার্লোস পেকুসেয়ে। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে খেলতে নামে ম্যারাডোনার দল।
দিয়েগো ম্যারাডোনার অনন্য ফুটবল প্রদর্শনীতে ২-০ গোলের জয় পায় আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৫২ ও ৬৩ মিনিটে দুটি গোল করেন ম্যারাডোনা। সেবারই বিশ্বকাপ ইতিহাসে সেরা একক পারফরম্যান্স করেছিলেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। ১৯৯০ সালে ইতালির বিপক্ষে সেমিফাইনালে ১-১ গোলে ড্র করে আর্জেন্টিনা। তবে ট্রাইব্রেকারে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক গয়কোচিয়ার বীরত্বে ৪-৩ গোলের জয় পায় তারা। যদিও ’৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে তাদের হারতে হয় ১-০ গোলে।
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সেমিফাইনালটা ১২০ মিনিটেও ছিল গোলশূন্য। তবে গোলরক্ষক সের্হিও রোমেরোর অসাধারণ পারফরম্যান্সে সেই ম্যাচেও জিতে যায় আর্জেন্টিনা। ১৯৯০ বিশ্বকাপের মতো সেবারও শিরোপা হাতছাড়া হয় জার্মানির কাছে হেরে। তবে এবার কাতারে সম্ভাব্য মেসির শেষ বিশ্বকাপ অবশ্যই রাঙ্গাতে চাইবেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা।
এবি