আহমেদ হূদয়
ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ১২:০৯ পিএম
আহমেদ হূদয়
ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ১২:০৯ পিএম
একেই বলে দ্য গ্রেটেস্ট শো-অন আর্থ। ফুটবলের সৌন্দর্য হয়তো এ কারণেই। এই আর্জেন্টিনাকে ঠেকানোর সাধ্য কার! পুরো লুসাইল স্টেডিয়ামজুড়ে ছিল শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকদের গর্জন। বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচটি রাঙালেন সোনালি ট্রফিতে চুমু দিয়ে। এ জন্যই হয়তো বলা হয়— ‘ওস্তাদের মাইর শেষ রাতে’।
২২তম ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে মেসি গোল করলেন, করালেন, জেতালেন দলকে, ভাসালেন আনন্দের জোয়ারে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব ফুটবল কাঁপানো ফুটবলার লিওনেল মেসি, বিশ্বকাপ জিততে না পারায় কতই না কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। নিজের ক্যারিয়ারের অধরা মাধুরি তার কাছেই ধরা দিলো বিশ্বকাপে।
নিজের শেষ ম্যাচ খেললেন, জিতলেন বিশ্বকাপের শিরোপা। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বিকেলেও গোটা বিশ্বকে আরও একবার দেখিয়ে গেলেন— তিনিই বিশ্বসেরা, তিনিই কিংবদন্তি, তিনিই ফুটবল জাদুকর। ৩৬ বছর পর দলকে ভাসালেন বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের জোয়ারে। মেসির নেতৃত্বেই তৃতীয় শিরোপা ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা।
এই আর্জেন্টিনাকে শেষ কবে দেখেছে গোটা বিশ্ব! এমন উল্লাস শেষ কবে করেছিল আর্জেন্টিনা! সে তো সেই ১৯৮৬ সালে। তখন ছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। মধ্যে ৩৬টি বছর কেটে গেলেও বিশ্বকাপের দেখা পাননি আকাশি-সাদা জার্সিধারীরা। মাঝে আবার দলে এলেন এক বিশ্বসেরা ফুটবলার। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব ফুটবলে রাজত্ব করে যাচ্ছেন তিনি।
তবুও ৩৬ বছরে হূদয় ভাঙার গল্পটাই ছিল বেশি। কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠেও হারতে হয়েছে একাধিকবার। অবশেষে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতে আলবিসেলেস্তেরা। বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠেছিল ২০১৪ সালে। সেখানেও হূদয় ভাঙার গল্প। জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে শিরোপ হাতছাড়া হয় মেসিদের।
এরপর ফ্রান্সের কাছে হেরে ২০১৮ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছিল আর্জেন্টিনা। তবে রোববার রাতে সেই ফ্রান্সকে হারিয়েই কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে শিরোপ উৎসব করল আলবিসেলেস্তেরা। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচের শুরু থেকেই আধিপত্য ধরে রেখে খেলতে থাকে আকাশি-সাদা জার্সিধারীরা।
ডি মারিয়া ও মেসির গোলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। ম্যাচের চার মিনিটে ডি পল ও আলভারেজের দারুণ বোঝাপড়ায় ডি পলের বাড়ানো বলে আলভারেজ শট নিলেও রেফারি অফসাইডের সিদ্ধান্ত দেন। ছয় মিনিটে ম্যাক এলিস্টারের দূরপাল্লার শট সোজা তালুবন্দি করেন ফ্রেঞ্চ গোলরক্ষক লরিস।
এর ঠিক দুই মিনিট পর আবারো আক্রমণে আর্জেন্টিনা। এবার ডি পল ডি-বক্সের বাইরে থেকে জোড়ালো শট নিলে ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডার ভারানের পায়ে লেগে বল বাইরে চলে গেলে কর্নার পায় আর্জেন্টিনা। অবশ্য সেই কর্নার কাজে লাগাতে পারেনি আলবিসেলেস্তারা।
১৬ মিনিটে আবারো গোলের সুযোগ পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। এবার ডি-পলের ডান পাশ থেকে বাড়ানো ক্রসে ডি মারিয়ার ডান পায়ের শট চলে যায় গোলবারের অনেক উপর দিয়ে। ম্যাচের ২১ মিনিটের মাথায় ডি মারিয়াকে ডি-বক্সের ভেতর ফাউল করে বসেন ডেম্বেলে। রেফারি সাথে সাথে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন। স্পট কিক থেকে গোল করে দলকে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে দিলেন মেসি।
৩৭ মিনিটে আর্জেন্টিনার দুর্দান্ত কাউন্টার অ্যাটাকে খেই হারিয়ে ফেলে ফ্রান্স। মাঝমাঠ থেকে মেসির পাস থেকে আলভারেজ বল পেলে সেটি বাড়ান ম্যাকএলিস্টারের উদ্দেশে, দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে তিনি বল দেন ডি মারিয়াকে। তিনি আর মিস করলেন না। কোপা আমেরিকার ফাইনাল, ফিনালিসিমার পর আরো একটি ফাইনালে গোল করলেন এই জুভেন্টাস তারকা। দুই গোলে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধেই জিরু ও ডেম্বেলেকে পাল্টে ফেলেন ফ্রান্স কোচ। তবুও তাদের ভাগ্যের চাকা ফিরেনি।
শেষ পর্যন্ত ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধেই খেই হারিয়ে বসে আর্জেন্টিনা। ৯৭ সেকেন্ডের মধ্যেই দুই গোল দিয়ে সমতায় ফেরে ফ্রান্স। ম্যাচের ৭৮ মিনিটে প্রতি আক্রমণে উঠে আসে ফ্রান্স। বক্সে আগুয়ান কিংসলে কোম্যানকে নিজেদের বিপদসীমায় ফাউল করে বসেন ওটামেন্ডি। পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। সেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন এমবাপ্পে।
৮১ মিনিটে দুর্দান্ত ভঙ্গিতে গোল করে দলকে ২-২ এ সমতায় ফেরান এই পিএসজি তারকা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হয় ২-২ গোলে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্থেও গোল করতে পারেনি দু’দল। তবে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্থে দলকে লিড এনে দেন লিওনেল মেসি। ১০৮ মিনিটে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন এলএমটেন।
পরে অবশ্য লিড ধরে রাখতে পারেনি তারা। খেলার দুই মিনিট বাকি থাকতে দূরপাল্লার শট ঠেকাতে গিয়ে হ্যান্ডবল হয়। পেনাল্টি থেকে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান এমবাপ্পে। সেই সাথে পূর্ণ করেন নিজের হ্যাট্টিক। অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষ হয় ৩-৩ গোলে। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। দুর্দান্ত ফাইনালে অবসান টাইব্রেকারে। বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেও ট্র্যাজিক হিরো থাকতে হলো কিলিয়ান এমবাপ্পেকে। ৩৬ বছরের অবসান ঘটিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা।
এর আগে তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপার সন্ধানেই কাতারে পাড়ি জমিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের বিপক্ষে অঘটনের শিকার হয় আর্জেন্টিনা। আর তাতেই থমকে দিয়েছিল কোটি ভক্তের স্বপ্নকে। তবে পরের ম্যাচেই ঘুরে দাঁড়ায় লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মেসি-ডি মারিয়াদের।
মেক্সিকো, পোল্যান্ডকে হারায় গ্রুপপর্বে। দ্বিতীয় রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া, কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডস, সেমি ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া ও ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয় বিশ্বকাপ ঘরে তুলে আর্জেন্টিনা। মেক্সিকোর মাটিতে ১৯৮৬ সালে একক নৈপুণ্যেই দলকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। এরপর দীর্ঘ ৩৬ বছর পর সোনালি ট্রফিটা ঘরে তুলল আলবিসেলেস্তেরা।